তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যতো কথা

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

বিএনপির তরফ থেকে দায়ের করা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের আবেদনের শুনানি আগামী বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ২৭ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন একই বিষয়ে রিভিউ আবেদন করেছিলেন।

প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নির্বাচন পদ্ধতি। নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে, নাকি অনির্বাচিত নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে– এ নিয়ে দফায় দফায় উত্তাপ ছড়িয়েছে দেশের রাজনীতি। এমন বিতর্কের অবসান হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। তখন প্রবল বিক্ষোভের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষমতাসীন বিএনপি। কিন্তু ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে এই নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করে দেয়।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাডভোকেট এম সলিমউল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৪ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। সেই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে আপিল করে রিট আবেদনকারী পক্ষ। এই আপিল মঞ্জুর করে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ এর ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। ঘোষিত রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ এর ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয়।

এরপর ২০১১ এর ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে করা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে সংসদ চাইলে পরবর্তী দশম ও একাদশ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় দিয়েছিলেন। এর পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে এর আলোকে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়ন করে।

তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৫ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল-সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। বাকিরা হলেন– তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। তাদের পক্ষে অ্যাডভোকেট শরীফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন রিভিউ আবেদন করেন।

অন্যদিকে গত ১৬ অক্টোবর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষেও আপিল বিভাগে আরেকটি রিভিউ আবেদন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হলে দিন ধার্য করেন চেম্বার আদালত।

বিএনপি ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পরই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়েছিল। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেওয়ার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৬৭। এর পেছনে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ইচ্ছা লুকায়িত ছিল বলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে। কারণ, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু ছিল।

সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে জুনের শেষের দিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কে এম হাসান। তখন অভিযোগ উঠেছিল, বিএনপি সরকারের পছন্দের কারণেই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কে এম হাসানকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান অবসরের পরপরই যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন।

আওয়ামী লীগের সহিংস আন্দোলনের মুখে বিচারপতি কে এম হাসান ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরের শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সংবিধান অনুযায়ী সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব না নিলে তার আগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা। এভাবে চারটি বিকল্প ছিল সংবিধানে। কেউ দায়িত্ব নিতে না চাইলে সর্বশেষ উপায় হিসেবে রাষ্ট্রপতির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু সংবিধানের সব বিকল্প না দেখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।

রাষ্ট্রপতি বিএনপির মনোনীত হলেও তিনি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেন, তখন আওয়ামী লীগ সরাসরি আপত্তি করেনি। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে, তিনি বিএনপির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছেন। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে চারজন সদস্য পদত্যাগ করেন। শুরু হয় আরেক সংকট।

আওয়ামী লীগ এবং অন্য বিরোধী দলগুলোর তীব্র আপত্তির মুখেও ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করলে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দেয়। সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত হয় নতুন আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তিন মাসের বদলে সেই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন দেয়। এর পর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তিনটি ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই তিন নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বোর্ডে বিক্ষোভ - dainik shiksha বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বোর্ডে বিক্ষোভ পাসের দাবিতে ফেল করা শিক্ষার্থীদের পাঁচ শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও - dainik shiksha পাসের দাবিতে ফেল করা শিক্ষার্থীদের পাঁচ শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও ছাত্র হত্যা : কর্মচারীদের দিয়ে বডি ম্যাসাজ নেয়া সেই অধ্যক্ষ গ্রেফতার - dainik shiksha ছাত্র হত্যা : কর্মচারীদের দিয়ে বডি ম্যাসাজ নেয়া সেই অধ্যক্ষ গ্রেফতার চবিতে শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগের সং*ঘর্ষ - dainik shiksha চবিতে শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগের সং*ঘর্ষ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পবিপ্রবিতে কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা শুক্রবার, শেষ হয়েছে সব প্রস্তুতি - dainik shiksha পবিপ্রবিতে কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা শুক্রবার, শেষ হয়েছে সব প্রস্তুতি প্রাথমিকে উপবৃত্তি বন্ধের তথ্য সঠিক নয়: অধিদপ্তর - dainik shiksha প্রাথমিকে উপবৃত্তি বন্ধের তথ্য সঠিক নয়: অধিদপ্তর please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027458667755127