তদন্ত, রিমান্ড বিচারিক আদালতে নয় কেন

রায়হান কাওসার |

কয়েকদিন আগে জুরাইনে হেলমেট ছাড়া উলটোপথে বাইক চালানোর অভিযোগে আইনজীবী ও পুলিশের মাঝে বাক-বিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায়ে স্থানীয় জনতা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পরবর্তীতে আইনজীবী ও অন্যান্য লোকজনকে আসামি করে পুলিশ মামলা দায়ের করে। উক্ত ঘটনায় পুলিশ অভিযুক্ত আইনজীবীকে গ্রেফতার করে এবং আইনজীবীকে পুলিশ রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করলে ম্যাজিস্ট্রেট তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আজকে, আমার মনে যে বিষয়টি বার বার আন্দোলিত হচ্ছে, তা হলো আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা নয়; বরং রিমান্ডের বিষয়টি। একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হতেই পারে কিন্তু জুরাইনের ঘটনায় আইনজীবীকে রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দানের পর বার বার মনে প্রশ্ন উদয় হচ্ছিল চাইলেই কি যে কোনো মামলায় আসামিকে রিমান্ডে দেয়া যায়? রিমান্ড মঞ্জুর করার কি সুস্পষ্ট মানদণ্ড আছে? কিংবা বর্তমান নিয়মের কোনো সংশোধন প্রয়োজন কিনা। যে কোনো জুডিশিয়াল অর্ডার যদি চ্যালেঞ্জযোগ্য হয়, তাহলে রিমান্ডের আদেশ কেন চ্যালেঞ্জ করার জন্য আসামিকে যথাযথ সময় প্রদান ও সহযোগিতা করা হবে না? যদি রিমান্ড আদেশ চালেঞ্জ করতে করতেই আসামিকে রিমান্ডে নেয়ার কাজ শেষ হয়ে যায়, তাহলে কী হবে? কিছুদিন আগেও দেখলাম, একজন অভিনেত্রীকে মাদকের মামলার তিন দফায় রিমান্ডে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হাইকোর্ট থেকে শোকজ খেলেন।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় বলা হচ্ছে, যখন একজন ব্যক্তি পুলিশকর্তৃক আটক হয় এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মামলার তদন্ত শেষ করা সম্ভব না হয়, তাহলে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আসামির রিমান্ডের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এখানে ‘মামলা’ এবং ‘তদন্ত’ শব্দ দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কোন ধরণের মামলা এবং কী ধরণের তদন্তের প্রয়োজনে পুলিশ রিমান্ড আবেদন করেছেন, তা বিচারিক মন নিয়ে দায়িত্বশীলতার সাথে বিবেচনা করতে হবে, মেকানিক্যালি নয়।

যেহেতু রিমান্ড অর্ডার একটি জুডিশিয়াল অর্ডার যা একজন ব্যক্তির মৌলিক অধিকার রাইট টু মুভমেন্টকে সংকুচিত করে, সামাজিকভাবে তাচ্ছিল্য ও অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে পতিত করে, আবার রিমান্ডশেষে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি তার নিজের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য প্রদান করেন, যার ওপর নির্ভর করে আদালত আসামিকে সাজা দিয়ে ফেলতে পারেন পরিস্থিতি বিবেচনায়। তাহলে কেন রিমান্ড মঞ্জুরের বিষয়ে আরও বেশি আইনি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে না? রিমান্ড মঞ্জুরের বিষয়টি কি So called প্রসিডিউরাল কাজ মনে করা সঠিক হবে?

যেহেতু রিমান্ড অর্ডার একটি জুডিশিয়াল অর্ডার, তা উচ্চতর আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য। কিন্তু বিবেচনায় নেয়ার মত বিষয় হলো রিমান্ড অর্ডারের সার্টিফাইড কপি কি চাওয়া মাত্র আমরা পাই? উচ্চতর আদালতে রিভিশন করা মাত্রই কি শুনানী করা যায়? রিমান্ড শুরুর আগেই কি অবৈধ রিমান্ড আদেশ বাতিল করা সম্ভব হয়? ফৌজদারি কার্যবিধি কিংবা ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডারে কি রিমান্ড আদেশের রিভিশন দ্রুত শুনে সেটি অবৈধ হলে বাতিল করার বিধান আছে? যদি সার্টিফাইড কপি তুলে উচ্চতর আদালতে রিভিশন করার আগেই আসামিকে রিমান্ডে নেয়ার কাজ শেষ এবং মাজিস্ট্রেটকর্তৃক যথারীতি দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়ে যায়, তাহলে কি আসামির অপূরণীয় ক্ষতি হবে না?

একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা এবং একটি জুডিশিয়াল অর্ডারকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য যথেষ্ট সুযোগ না থাকা সংবিধানের ৩৩ ও ৩৫(৪) অনুচ্ছেদের সরাসরি সাংঘর্ষিক। তাই একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে রিমান্ড অর্ডার চ্যালেঞ্জ করার জন্য আসামিকে অন্তত ২৪ ঘণ্টা সময় দেয়া দরকার এবং রিমান্ড উদ্ভূত রিভিশন শুনানির জন্য একজন দায়রা জজের নেতৃত্বে একটি বিশেষ রিভিশন আদালত স্থাপন করা উচিত, যাতে করে একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হন। আর যদি সেটা না করা যায়, তাহলে শুধু রিমান্ড শুনানির জন্য দায়রা জজ পদমর্যাদার একজন বিচারককে নিয়ে বিশেষ রিমান্ড আদালত গঠন করা উচিত। তবে আরেকটি নতুন পন্থার কথা চিন্তা করা যায়। তা হলো, যে মামলা যে কোর্টে বিচারযোগ্য, সে মামলাগুলো আমলে নেয়া, রিমান্ড মঞ্জুর করার এখতিয়ার সে সকল কোর্টে প্রদান করতে হবে। যেগুলো দায়রা আদালতে বিচারযোগ্য, সে মামলাগুলোর তদন্ত, রিমান্ড ও আমলে নেয়ার এখতিয়ার দায়রা জজের হাতে থাকবে। যেহেতু একটি মামলার বিচার করার ক্ষমতা ম্যাজিস্ট্রেটের নেই, সেই মামলার তদন্ত, রিমান্ড ও আমলে নেয়ার ক্ষমতাও তার থাকা উচিত নয়। একজন মাজিস্ট্রেট যে মামলার বিচার করার ক্ষমতা রাখেন, শুধু সেগুলোর তদন্ত, রিমান্ড ও আমলে নেয়ার এখতিয়ার তার থাকা উচিত, দায়রা আদালতে বিচারযোগ্য মামলায় নয়। যেমন, নারী ও শিশু ট্রাইবুনাল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে ফাইলকৃত কমপ্লেইন্ট পিটিশনগুলোর তদন্তের নির্দেশ, আমলে গ্রহণ ও বিচার উক্ত ট্রাইবুনাল নিজেই করেন। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে গিয়ে একজন বাদীকে কমপ্লেইন্ট পিটিশন ফাইল করতে হয় না।    

আমার মনে হয়, সিআরপিসি’র ১৬৭ ধারা অনুযায়ী রিমান্ড প্রদানের বিষয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে যে পরিমাণ ডিস্ক্রিশনারি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তা তাঁর বিচারিক অভিজ্ঞতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। রিমান্ড শুনানির জন্য একটি বিশেষ রিমান্ড আদালত গঠন করা দরকার, যেখানে একজন দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারক শুনানি শেষে অভিযুক্ত ব্যক্তির রিমান্ড মঞ্জুর করবেন। একটি রিমান্ড আবেদনে কিছু বিষয়ের উপস্থিতি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি।

যেমন পুলিশ যে সমর্থনমূলক ডকুমেন্ট বা সাক্ষ্যের জন্য ভাবলেন যে আসামিকে রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন, তা সুস্পষ্টভাবে আবেদনে লিখবেন। গৎবাঁধা কথা লিখলে হবে না। দূরবর্তী ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হবে না।

পুলিশ কি আটককৃত আসামির অপরাধ সংঘটন ব্যাপারে অতিরিক্ত প্রমাণের জন্য রিমান্ড চান? না অন্যান্য আসামির ব্যাপারে তথ্য জানার জন্য রিমান্ড চান, না কোনো মালামাল উদ্ধারের জন্য রিমান্ড চান- তা আবেদনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী পুলিশের আবেদনে উল্লেখিত কারণ কতটুকু যৌক্তিক তা বিবেচনা করে আদেশ দেবেন এবং নিজস্ব পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করবেন।
 
উক্ত তদন্তের জন্য জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা যথেষ্ট কিনা কিংবা পুলিশের হেফাজতে রাখা সমীচীন কিনা সে ব্যাপারে অবজারভেশন দেবেন।

পুলিশকর্তৃক রিমান্ড আবেদনে উল্লেখিত কারণের বিরুদ্ধে আসামির কোনো বক্তব্য থাকলে তা আদেশে লিপিবদ্ধ করবেন।

রিমান্ডের প্রথম ধাপে পুলিশ নতুন কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বা আলামতের বিষয়ে কোনোরূপ আশাব্যঞ্জক কিছু না উপস্থাপন করতে পারলে দ্বিতীয় ধাপে রিমান্ড মঞ্জুর করা যাবে না। যদি মঞ্জুর করা হয়, তাহলে, আসামি উক্ত অর্ডার চ্যালেঞ্জ করবে কিনা সে বিষয়ে আসামিকে জিজ্ঞেস করতে হবে এবং সে অর্ডার চ্যালেঞ্জের যথাযথ সুযোগ দিতে হবে। কেননা দ্বিতীয় ধাপের রিমান্ডে আসামি প্রথম রিমান্ডের চেয়ে অনেক ভীত ও নাজুক অবস্থায় থাকে এবং মানসিক চাপ অনুভব করে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করতে পারে, যা সংবিধানের ৩৫(৪) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। 

যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো শাখা মামলার অভিযোগকারী হয়, তখন সেই শাখার হেফাজতে আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করা যাবে না। অন্য শাখাকে দায়িত্ব দিতে হবে। কেননা এক্ষত্রে আসামিকে অভিযোগকারীর হেফাজতে দেয়া হলে আসামি মারাত্মকভাবে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন এবং তা ন্যাচারাল জাস্টিসের নীতিবিরুদ্ধ হবে। জুরাইনে আইনজীবীর সাথে পুলিশের বাক-বিতণ্ডায় পুলিশ সরাসরি বাদী হয়ে মামলা করেছে।এক্ষেত্রে পুলিশের হাতেই আসামিকে রিমান্ডে তুলে দেয়া কতটা ন্যায্য সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বার বার ভাববার বিষয়।

এছাড়াও সার্বিকভাবে আরও একটি পরামর্শ রয়েছে আমার। তা হলো জুডিশিয়াল অমবুডসম্যানের ব্যবস্থা করা। আমাদের সংবিধানে ৭৭ অনুচ্ছেদে Ombudsman এর বিধান রয়েছে। এর কাজ হলো প্রজাতন্ত্রের কাজে-কর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। আমাদের বিচার বিভাগের সকল কর্মকর্তা নায়বিচারের প্রতীক হবেন, সেটা বিবেচনা করা সমীচীন নয়। দশজনের মধ্যে একজন খারাপ হতেই পারে, কেননা তাঁরা ফেরেস্তা নন, রক্তমাংসের মানুষ। অনেক সময় ব্যক্তিগত ইগো থেকে, কন্ট্রোলিং বিচারকের প্রেসারে কিংবা ব্যক্তিগত লোভে পড়ে কিংবা ওপর মহলের শক্তিশালী তদবিরের কারণে একজন বিচারক অনিয়ম করবেন না, তা ভাবা সঠিক হবে না। একজন অফিসার অপরাধ করলে তার বিচার হবে ঠিক আছে, কিন্তু অপরাধ যাতে সংঘটিত না হয়, সেটি যেন সংঘটনের আগেই পরিহার করা যায়। সেজন্য বিচার বিভাগে দরকার জুডিশিয়াল অমবুডসম্যান। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির মধ্য থেকে জুডিশিয়াল অমবুডসম্যান নিয়োগ একটি ভাল সিদ্ধান্ত হতে পারে এক্ষেত্রে।

 

লেখক : রায়হান কাওসার, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034070014953613