সরদার ভাইকে আমি প্রথম দেখি উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে। তিনি তখন বাংলা একাডেমীতে কাজ করতেন। বর্ধমান হাউসের নীচের তলায় বসতেন। বেঁটে খাটো মানুষ। সব সময়ে হাফশার্ট পরতেন । বৃষ্টি বাদলার সময় একটি লেডিস ছাতা তার হাতে থাকতো । এখন যেভাবে মাথার একপাশে সিঁথি কাটেন, তখনও সে রকম সিঁথি কাটতেন। তবে সে সময়ে চুলগুলো কালো ছিলো। সরদার ভাই গোছানো এবং পরিপাটি স্বভাবের মানুষ । সৌখিন মানুষ বলতে যা বোঝায় সরদার ভাইকে সে দলে ফেলা যাবে না। তবে তিনি খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতেন ।
মুখ্যত: রাজ্জাক স্যারের আগ্রহাতিশয্যে দর্শনের লোক হওয়া সত্ত্বেও সরদার ভাইয়ের রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসাবে যোগ দিতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। রাজ্জাক স্যার আমাকে স্নেহ করতেন। তাঁর বাড়িতে আমার যাতায়ত ছিল। রাজ্জাক স্যার আমাকে দু’জন মানুষের সম্পর্কে সবসময় বলতেন, তাঁদের একজন বাংলা বিভাগের শিক্ষক ডক্টর আনিসুজ্জামান, অন্যজন হলেন সরদার ফজলুল করিম। সে সময় সরদার ভাইয়ের প্লেটোর সংলাপ বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। রাজ্জাক স্যারই আমাকে তাগাদা দিয়ে বইটা পড়তে একরকম বাধ্য করেন। এই অনুবাদটি পড়ার পূর্বে আমি সরদার ভাইয়ের নানা টুকিটাকি রচনা পড়েছিলাম। এ ধরনের লেখা থেকে একজন মানুয়ের পূর্ণ পরিচয় লাভ সম্ভব হয় না। প্লেটোর সংলাপ গ্রন্থটি পাঠ করার পর সরদার ভাইয়ের পাণ্ডিত্য, দর্শনের প্রতি অনুরাগ এবং বাংলাভাষার প্রতি দখল সম্পর্কে আমার মনে একটা নতুন ধারণা জম্ম নিল। প্লেটো, এ্যারিস্টোটলের রচনার বাংলা অনুবাদ ঢাকা এবং কলকতায় আরো হয়েছে। কিন্তু গভীরতা এবং রচনা শৈলীর বিচারে তার কোনটাই সরদার ভাইয়ের অনুবাদের কাছাকাছি আসতে পারেনি। সরদার ভাই পরে আরো অনেক অনুবাদ করেছেন এবং ‘দর্শনের পরিভাষা কোষ’ রচনা করেছেন। গ্রীক দর্শনকে বাংলা ভাষাভাষী জগতে পরিচিত করার ব্যাপারে সরদার ভাই পথিকৃতের ভূমিকা পালন করছেন।
দর্শন ও অন্যান্য বিষয়ের অনুবাদ আমাদের দেশে যথেষ্ট না হলেও বেশ কিছু প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ সমস্ত অনুবাদকদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ না করেও একটি কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়, মাতৃভাষায় যথাযথ দখল না থাকলে অন্যদেশীয় ভাবধারা এবং জ্ঞানবিদ্যা দেশীয় মনের উপযোগী করে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। সরদার ভাইয়ের রচনা রীতিটি এতই পরিচ্ছন্ন, এতই সাবলীল এবং গতিশীল মনে হবে এগুলো অনুবাদ নয়, মূল রচনা। কোন রচনা পাঠ করার পর যখন মনে হবে এগুলো অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে, অনুবাদের আসল উদ্দেশ্যটাই সেখানে মিথ্যে হয়ে যায়। আমি সামান্য মানুষ । আমার পড়াশুনা নিতান্তই স্বল্প। সরদার ভাইয়ের বিশাল ব্যক্তিত্বের পরিমাপ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি মানুষ সরদার ফজলুল করিমকে যেভাবে জেনেছি, সে বিষয়ে দু'একটি কথা বলে এ সংক্ষিপ্ত রচনার ইতি টানবো। আগেই বলেছি সরদার ভাই বেঁটে খাটো চেহারার মানুষ । আটপৌঢ়ে ধরনের কাপর চোপড়ে অভ্যস্ত। প্রথম দিন আমি যেমন তাকে হাফশার্ট পড়তে দেখেছি, এখনও দেখতে পাই। একই ধরনের শার্ট পড়ে তিনি সর্বত্র চলাফেরা করেন। তার নীলক্ষেতের বাড়িতেও আমার যাওয়া আসা ছিল। পারিবারিক জীবনে সরদার ভাই বোধ করি সুখী ছিলেন না। কিন্তু কাউকে ঘুণাক্ষরেও নিজের অসুবিধার কথা জানতে দিতে চাইতেন না । আমাদেরকে সব সময় হাসিমুখে গ্রহণ করতেন । এটা সেটা খেতে দিতেন। কোন গভীর তত্ত্ব কিন্বা দর্শনের প্রসঙ্গ উঠলেই নিজের দুঃখ দুর্দশা ভূলে যেয়ে এ বিষয়ের আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন। তিনি কোন বিষয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করার বেলায় সব সময় লক্ষ্য রাখতেন বিষয়টির প্রতি আমাদের যেন অনুরাগ সঞ্চার হয় । এখনো মাঝে মধ্যে পথে ঘাটে সরদার ভাইর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তিনি তিনটা জিনিস জিজ্ঞেস করেন, শরীর কেমন, এখন কি পড়ছেন, তার শেষ কথা-কি লিখছেন?
সরদার ভাইয়ের চরিত্রের আরেকটি দিকের কথা উল্লেখ করতে চাই। আমি তাঁকে কোনদিন কোন মানুষ সম্পর্কে কোনরকম নিন্দা বাক্য উচ্চারণ করতে শুনিনি। কেউ যদি তাকে খুব বেশি আহত করে সে বিষয়ে কিছু বলার প্রয়োজন হলে বলতেন, “উনার সঙ্গে আমার মতের মিল হচ্ছে না।" ব্যাস। আর কোন লোকের মধ্যে প্রশংসা করার সামান্য জিনিস থাকলেও সেটা তিনি অবলীলায় প্রকাশ করতেন । বিশেষ করে তরুণদের উৎসাহিত করার একটা ঝোঁক বরাবরই ছিল। তরুণদের তিনি সত্যি সত্যি ভালবাসতেন । তার হৃদয়ের উত্তাপ তরুণদের স্পর্শ করত। তিনি অত্যন্ত দুরূহ বিষয়গুলো তরুণ মনের উপযোগী করে সহজ ভাষায় প্রকাশ করতে পারতেন, এটি একটি অসাধারণ ক্ষমতা ।
এই সরদার ভাইয়ের বয়স সত্তর ছাড়িয়ে গেছে। তার জীবনের উপর দিয়ে ঝড়- ঝাপ্টা কম বয়ে যায়নি। জীবনে আশা ভঙ্গের পরিমাণও অল্প নয়। তার উপর একটি পা ভেঙ্গে গেছে। এই জখমী পা নিয়ে অতিকষ্টে তাকে চলাফেরা করতে হয়। একটি মাত্র ঘরে তাকে একা বাস করতে হয়। পরিবারের লোকজনের সংগে তার সম্পর্কের ধরনটিও হয়ত প্রীতিপদ এবং উত্তাপিত নয় । এতগুলো অসুবিধার মধ্যে বাস করেও সরদার ফজলুল করিমের অদম্য প্রাণশক্তি পরাজয় মেনে নেয়নি। তিনি সমানে কাজ করে যাচ্ছেন। তার নিষ্ঠা, ধৈর্য্য দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এই যে ছোটখাটো চেহারার মানুষ তার ভেতরে কী যে প্রাণশক্তি রয়েছে সে দিকে তাকিয়ে আমাদের অবাক এবং বিস্মিত হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না।