‘তানিয়া’ নামের ভুবনে খুবই পরিচিত। যদিও নামটি বাংলা ভাষার নয়। রুশ ভাষা থেকে আগত নামটি বাংলায়ও বেশ জনপ্রিয়। স্ত্রীবাচক এই নামে মানুষ খুঁজে পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। আশপাশেই দেখা মেলে এ নামে অসংখ্য মানুষ। বাংলায় নামটির প্রচলন কীভাবে, তার তত্ত্বতালাশ এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য এ নামে একটি উপন্যাসের পাঠ নিজের সঙ্গেই নিজে আবার ঝালিয়ে নেওয়া। ‘তানিয়া’ উপন্যাসটির রচয়িতা পি. লিডভ। রুশ ভাষার এই সাহিত্যিকের উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদ করেন আহমদ ছফা (৩০ জুন ১৯৪৩-২৮ জুলাই ২০০১)। শুক্রবার (২৮ জুলাই) আমাদের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরো জানা যায়, কয়েক দশকের সাহিত্যসাধনায় আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন ত্রিশের অধিক বই রচনার মাধ্যমে। তিনি এ উপন্যাসটি অনুবাদ করেন ছাত্রাবস্থায়। তার প্রথম মুদ্রিত বই হিসেবে ধরা হয় এ অনুবাদ উপন্যাসটিকে। অবশ্য একই বছর প্রকাশ পায় তার উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’। এখানে উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আখ্যান। তানিয়ার প্রথম প্রকাশ বাংলাবাজারের অধুনালুপ্ত প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রকাশভবন’ থেকে। পরে মুক্তধারা থেকে উপন্যাসটির একাধিক সংস্করণ এবং প্রাচ্যবিদ্যা নামক প্রকাশনী থেকে আরও একটি সংস্করণ প্রকাশ পায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত রুশ উপন্যাস ‘তানিয়া’ কেন অনুবাদে আগ্রহী হয়েছিলেন আহমদ ছফা, তা আজ জানার সুযোগ নেই। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সংঘটিত সবচেয়ে বড় যুদ্ধের অন্যতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ। এই ছয় বছরে বিশ্বে প্রায় সব পরাশক্তি এবং রাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পক্ষ-প্রতিপক্ষ হিসেবে গড়ে ওঠে দুটি সামরিক জোট। একদিকে অক্ষশক্তি, অন্যদিকে মিত্রশক্তি বা বাহিনী। প্রায় ৫ থেকে সাড়ে ৮ কোটি মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের নৃশংসতম যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই এ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট।
তানিয়া, বইটির শুরুতেই বলা হয়েছে, জনৈক রাশিয়ান বীর কিশোরীর মর্মস্পর্শী কাহিনি। এই জনৈক লেখক পি. লিডভ। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কে তুলে এনেছেন রুশ তরুণী তানিয়ার মধ্য দিয়ে। তানিয়াকে প্রাণদ- দেওয়া হয়েছে। জার্মানদের আক্রমণ তখন অপ্রতিহত। শত্রুর সাঁড়াশি আক্রমণের সামনে মস্কো নগরী তখন আতঙ্কিত প্রহর গুনছে। সময়টি ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুতে। আবহাওয়া প্রচ- খারাপ। তীব্র শীতে কাবু মানুষ। এই সময়েই জার্মানরা পেট্রিশ্চেভ অঞ্চলের ভেরিয়া শহরের কাছে একজন সৈনিকের প্রাণদ- দিয়েছে। উপন্যাসের শুরু এই প্রাণদ-ের ঘোষণার মধ্য দিয়েই। যে সৈনিকের প্রাণদ- দেওয়া হয়েছে, সে একজন তরুণী। তার পরিচয়, তার নাম তানিয়া। তার বিস্তারিত আর কিছুই জানা যায় না। কারণ প্রচ- নির্যাতনেও তরুণী তার পরিচয় প্রকাশ করেনি। তরুণীটি ফ্রন্টের বিচ্ছিন্ন সৈন্যদলকে সাহায্য করার জন্য আসা অকুতোভয় স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে মস্কো থেকে এসেছিল। জার্মান সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করার মিশনে সে ধরা পড়ে একটি আস্তাবল থেকে। ভেরিয়া জেলায় এসে তানিয়াদের দলটি এক রাতে জার্মানদের যুদ্ধক্ষেত্রের সবগুলো টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সেই রাতেই সতেরোটি জার্মান সৈন্যবাহিনীর ঘোড়ার আস্তাবল ধ্বংস করে। পরের রাতে তানিয়া প্রবেশ করে শত্রুর দুশরও বেশি ঘোড়া রাখা এক আস্তাবলে। এখানে আস্তাবলটি ধ্বংসের আগে, যখন সে গ্যাসোলিনের বোতল থেকে তরল পদার্থ চারদিকে ছিটিয়ে দিয়াশলাই ঘষে আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই শত্রু সেনার একজন সান্ত্রী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত দুটো চেপে ধরে এবং সতর্কঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। ধরা পড়ে রুশ সৈনিক। আলোয় সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখে, সৈনিকটি একটি মেয়ে। পরদিন তার ফাঁসির আদেশ জেনেও পরিবার এবং সহযোদ্ধাদের বিপদের মুখে না ফেলতে জার্মান সেনাবাহিনীর ক্রমাগত অত্যাচারের মুখেও সে তার পরিচয় প্রকাশ করে না। ফাঁসিকাষ্ঠে তার মৃত্যুদ- কার্যকরের পর প্রায় এক মাস ঝুলে থাকে তার দেহ। শুধু তাই নয়, তার মৃতদেহ চূড়ান্ত অসম্মানের সঙ্গে সর্বোচ্চ নৃশংসতারও শিকার হয়। নববর্ষের আগে মাতাল ফ্যাসিস্টরা তানিয়ার মৃতদেহের সামনে এসে তার ঝুলন্ত শরীর থেকে কাপড়চোপড় খুলে নিয়ে সব ধরনের জঘন্য উপায়ে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করার পর চাকু দিয়ে তানিয়ার দেহ ফালি ফালি করে কেটে ফেলে। পহেলা জানুয়ারি সন্ধ্যায় বরফ জমা মাঠে একটি ছোট গর্ত করে কোনো সম্মান দেখানো ছাড়াই তাকে কবর দেওয়া হয়। অবশ্য এরই মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করে। মস্কো জয়ের কোনো ভরসা না দেখায় পালাতে শুরু করেছে জার্মানরা। তাদের তাড়িয়ে নিয়ে আসা বীর রুশ জেনারেল লিওনিদ গভোরভ পেট্রিশ্চেভে এসে সৈনিকদের উদ্দেশে তানিয়াকে স্মরণ করে বলেন, ‘বন্ধুগণ, তানিয়াকে স্মরণ করুন। ফ্যাসিস্টদের মস্তকের দিকে নির্ভুলভাবে আপনাদের রাইফেল তাক করুন।’ তানিয়ার বীরত্বের কথা ছড়িয়ে পড়ায় স্বয়ং জোসেফ স্তালিনও তার কবর দেখতে আসেন, শ্রদ্ধা জানান। সোভিয়েত ইউনিয়নের- সুপ্রিম সোভিয়েত এক ঘোষণায় সাম্যবাদী লীগের সদস্য জয়া কসমোডেসিয়ান স্কাইয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বীরের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এবার জানা যায়, তার আসল পরিচয়। যুদ্ধক্ষেত্রে ধরা পড়ে সে কাউকেই নিজের পরিচয় দেয়নি। শুধু ভেরিয়ার যে সৈনিকের সঙ্গে পরিখায় তার দেখা হয়েছিল, তাকেই নাম বলেছিল তানিয়া। মৃত তানিয়ার শরীর যেভাবে অসম্মানিত করা হয়েছে, জীবিত তানিয়াকে ধরার পর, তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর আগে ততটাই নির্যাতন করা হয়েছে। কিন্তু সে তার দৃঢ়তা হারায়নি। তাই ফাঁসিকাষ্ঠে গলায় দড়ি নিয়ে, সমবেত রুশদের, যাদের বাধ্য করা হয়েছে ফাঁসি দেখতে আসার জন্য, তাদের উদ্দেশে বলেছে, ‘কমরেডবৃন্দ! আপনারা এত বিমর্ষ কেন? মনোবল জাগিয়ে তুলুন। রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। বিমর্ষতা আপনাদের জন্য নয়। কমরেডবৃন্দ! মরতে আমি ভয় পাইনে। নিজের দেশের জনসাধারণের জন্য মরার চাইতে গৌরব আর কিছুতে নেই।’ জল্লাদ যখন অধিনায়কের ঘোষণা কার্যকর করছে, তখনো তানিয়া বলছে, ‘তোমরা এখন আমাকে ফাঁসি দিচ্ছ। কিন্তু আমরা বিশ কোটি মানুষ। সবাইকে তোমরা ফাঁসিতে লটকাতে পারবে না। প্রতিশোধ অবশ্যই নেওয়া হবে। এখনো সময় আছে। আত্মসমর্পণ করো। জয় অবশ্যই আমাদের।’
সাম্যবাদে দীক্ষিত দশম গ্রেডের ছাত্রী তানিয়ার মধ্য দিয়ে মূল লেখক দেশের জন্য একজন নিবেদিত মানুষের যে গতি দেখিয়েছিলেন, সম্ভবত সেই গতিই আকৃষ্ট করেছিল আহমদ ছফাকে উপন্যাসটি অনুবাদে। উপন্যাসটির অনুবাদ এবং তার প্রকাশকাল বিবেচনায় আনলে আমাদের প্রেক্ষাপটও সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি দেশ যখন অন্যের দ্বারা শোষিত হচ্ছে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং তার পরবর্তী আন্দোলনগুলোর ধারাবাহিকতায় আমাদের মধ্যে দৃঢ় হচ্ছে জাতীয়তাবোধ। সেই দৃঢ়তাকে আঁকড়ে ধরেই শত্রুর মুখোমুখি হয়ে প্রতিবাদে এবং প্রতিরোধে ইস্পাত হয়ে ওঠার ইঙ্গিত তানিয়া। উপন্যাসটির কয়েকটি অংশ। প্রথমাংশের পর রয়েছে তানিয়ার মায়ের বেতার বক্তৃতা, ফ্রন্ট থেকে চিঠি এবং আমার মেয়ে জয়া। তানিয়া, যার আরেক নাম জয়া, সে তার ডায়েরিতে টুকে রাখত যেসব বই সে পড়ত, তার থেকে নির্বাচিত অংশ। যুদ্ধে যাওয়ার আগে তার সেই ডায়েরিতে টুকে রাখা অংশ থেকে উপন্যাসের বর্ণনার ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে কিছু নমুনা। ‘সাম্যবাদী’ হওয়া মানে সাহস করা, চিন্তা করা, আশা করা এবং ঘাড়ে দায়িত্ব নেওয়া। মায়াকভস্কি। রয়েছে চেখভের একটি উদ্ধৃতি- ‘মানুষের কাপড়চোপড়, আত্মা, চিন্তা, মুখম-ল সবকিছু সুন্দর হওয়া উচিত।’
আহমদ ছফা তার কয়েক দশকের লেখালেখিতে বরাবরই সময়কে চিহ্নিত করেছেন। ‘তানিয়া’ উপন্যাস অনুবাদের মধ্য দিয়েও তার সেই সময়কে চিহ্নিত করার প্রবণতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘ছফা কেবল পাঠ করার বিষয় নয়, চর্চা করার বিষয়’- বলেছিলেন সরদার ফজলুল করিম। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সেই চর্চার বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
লেখক : মামুন রশীদ