সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ‘কিলো সড়কে’ বসে কয়েক দিন ধরে উপাচার্য (ভিসি) ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ চেয়ে স্লোগান দিচ্ছেন। ‘কিলো সড়কটি’ উপাচার্যের বাসভবন থেকে প্রায় ৭০-৮০ ফুট দূরে। শিক্ষার্থীরা মাইক নিয়ে স্লোগান দেওয়ায় কমবেশি সব সমালোচনাই নিজ কানে শুনছেন উপাচার্য। বাসায় থাকা মনিটরে সিসি ক্যামেরায় শিক্ষার্থীদের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ড দেখাও স্বাভাবিক। তিনি নিজে গত রোববার সন্ধ্যা থেকে আর বাসা থেকে বেরোননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপাচার্যের সঙ্গে বাসায় তাঁর স্ত্রী আছেন। বাবুর্চিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মচারী আছেন। এ ছাড়া বাসভবনের আশপাশে সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রশমিত করতে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে উপাচার্য তাঁদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। গত রোববার বেলা সোয়া তিনটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দফার দাবিতে উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে অবরুদ্ধ করে রাখেন। ওই দিন বেলা সাড়ে পাঁচটার দিকে পুলিশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে উপাচার্যকে মুক্ত করে তাঁর বাসভবনে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা সাতটার দিকে উপাচার্য তাঁর বাসভবনে জরুরি সিন্ডিকেট বৈঠক ডাকেন। পরে রাত সাড়ে আটটার দিকে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ এবং পরের দিন সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেন।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণার পরপরই শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হন। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে সেই থেকে লাগাতার আন্দোলন করে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংগত কারণেই উপাচার্য দুশ্চিন্তায় আছেন। তবে তিনি সেটি প্রকাশ করছেন না। এই কয় দিনে তাঁর দৈনন্দিন রুটিনেও অনিয়ম তৈরি হয়েছে। ঘুম ও খাওয়াতেও এর প্রভাব পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত রোববার সন্ধ্যায় উপাচার্যকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করে পুলিশ তাঁর বাসভবনে নিয়ে যান। বাসার ভেতরে ঢোকার পর থেকে উপাচার্য আর বাসার বাইরে বের হননি। গত কয়েক দিনে তিনি সিলেট আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ, জ্যেষ্ঠ শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। অচলাবস্থা নিরসনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুনরায় শিক্ষক নেতা ও রাজনীতিবিদদের আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
উপাচার্যের সঙ্গে কয়েক দিনে দেখা করতে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বিশ্বাস করেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই চলমান সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এই সময়ের মধ্যে তিনি বাসায় বসে ঢাকায় থাকা আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক নেতা, সিলেটের স্থানীয় কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছেন।
কয়েকজন সাধারণ শিক্ষকের ভাষ্য অনুযায়ী, উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতাদের অনুরোধ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে শিক্ষক সমিতির সভাপতি তুলসী কুমার দাস ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুহিবুল আলম, আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ’-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. মস্তাবুর রহমানসহ কয়েকজন প্রতিনিধি শিক্ষার্থীদের কাছে যান। তবে শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ না করলে শিক্ষক নেতাদের কোনো কথাই শুনবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। এ অবস্থায় শিক্ষক নেতারা কথা না বলেই ফিরে যান।
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে যান। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতারা শিক্ষার্থীদের বলেন, যেহেতু শিক্ষার্থীদের প্রথম দাবিগুলো প্রশাসন মেনে নিয়েছে, শিক্ষার্থীদের উচিত ঘরে ফিরে যাওয়া। এর বিপরীতে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তাঁরা এখন এক দফার দাবিতে আন্দোলন করছেন। আর তা হলোÑউপাচার্যের পদত্যাগ।
আওয়ামী লীগ নেতারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে বেলা দেড়টার দিকে উপাচার্যের বাসভবনে যান। পরে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আওয়ামী লীগের নেতারা উপাচার্যের বাসভবন থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, আওয়ামী লীগ নেতারা চলে যাওয়ার পর উপাচার্য একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে চলমান পরিস্থিতি বিষয়ে কথা বলেন। তবে এ অবস্থায় করণীয় কী, তা তাঁরা নির্ধারণ করতে পারেননি। ফলে পরবর্তী পরিস্থিতি আসলে কী হতে চলেছে, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে ধারণা করতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে গত দুই দিন একাধিকবার মুঠোফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তিনি তা দেখলেও কোনো জবাব দেননি। তবে গত সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপাচার্য তাঁর বাসভবনে দুজন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তখন অভিযোগ করেন, অনেক বহিরাগত কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে।
বেগম সিরাজুন্নেসা হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তিন দফা দাবিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে হলের কয়েক শ ছাত্রী উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সূচনা।