তীব্র তাপপ্রবাহ শিক্ষার ব্যবধান বাড়াবে

মাছুম বিল্লাহ |

ঈদুল ফিতর ও তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে দীর্ঘদিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ থাকার পর দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিরচেনা ঘণ্টা বাজার কথা থাকলেও বাজেনি ২১ এপ্রিল। নব প্রাণে যেনো জাগা শুরু করেছিলো উচ্ছ্বাস। শিশু কিশোরদের কলকাকলিতে শ্রেণিকক্ষের প্রাণ ফেরা শুরু হলেও আবারও বিপত্তি বাধে তীব্র তাপপ্রাবাহের কারণে। বিরূপ আবহায়া যেনো অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুখ। অসহ্য গরমে শিক্ষার্থীদের বসতে হয়েছে গাদাগাদি করে। মাথার ওপর ফ্যান থাকলেও তা স্বস্তি দিতে পারছিলো না। তাই অনেকের হাতে হাতপাখা বা চার্জার ফ্যানও দেখা গেছে। হাতে থাকা রুমাল বা টিস্যুতে ঘাম মুছে অস্বস্তি থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে অনেকেই। স্কুলে যাওয়া-আসার ভোগান্তিতে অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে তাদের পড়ার মনোযোগ।

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে এক সপ্তাহ বাড়ানো হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে, লোডশেডিং, খাবার পানির সংকট, বেশ কয়েকজন শিক্ষকসহ বেশকিছু শিক্ষার্থীর  তাপজনিত স্ট্রোকে মৃত্যু সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। এসব ঘটনাগুলো গণমাধ্যমের সুবাদে সবার নজরে আনা হলে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেন। উদ্বিগ্ন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সবাইকে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তীব্র তাপপ্রবাহ চলাকালে শিক্ষার্থীদের সশরীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না নিয়ে অনলাইনে বা বিকল্প অন্য কোনোভাবে ক্লাস নেয়া যায় কি না তা বিবেচনা করার অনুরোধ করেছেন। অভিভাবকরাও এ বিষয়ে অনেকটাই একমত পোষণ করেছেন। তবে, শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কোথাও বেশি গরম আছে মানেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে-এটার কোনো মানে নেই।’ তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে এই মন্তব্যকে কটাক্ষ করেছেন। তারা বলেছেন এসি রুমে বসে সিদ্ধান্ত দেয়া ঠিক নয়, ঢাকায় বসে পুরো দেশের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয় ইত্যাদি।  

সার্বিক বিষয় নিয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে হবে তবে সেটি শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষকদের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে। আর তাই, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের প্রয়োজন নেই, যেখানে যে অবস্থা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা। অর্থাৎ যেসব এলাকায় একটু বৃষ্টি হয়েছে কিংবা ঠান্ডা সেসব এলাকায় বিদ্যালয় বন্ধের প্রয়োজন নেই। আবার কোথাও কোথাও ভালো ফ্যান এমনকি শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সম্বলিত শ্রেণিকক্ষ রয়েছে, সেসব বিদ্যালয় বন্ধের প্রয়োজন নেই তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আসা-যাওয়ার সময় তারা তাপপ্রবাহের শিকার হবেন, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত হবে এলাকাভিত্তিক ও বিদ্যালয়ভিত্তিক। বিদ্যালয় কমিটি এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সে ধরনের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। এখানেও সমস্যা পান থেকে চুন খসানো বিষয়টিও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের হয় কমিটি, নয় সরকারি কর্মকর্তা কিংবা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিদের্শে করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত প্রয়োজন যাতে এসব স্থানীয় কোনো উপদ্রব না ঘটে। কিন্তু বিদ্যালয় বন্ধের ক্ষেত্রে সবার জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হতে পারে না। শিক্ষায় এমনিতেই স্থান ভেদে বিশাল গ্যাপ সৃষ্টি হয়ে আছে। কীভাবে সেই গ্যাপ পূরণ করা হবে তার সঠিক কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। তার ওপর আবার এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। শিক্ষাক্ষেত্রে এ যেনো মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে জলবায় উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা উচ্চতার শিখরে পৌঁছায়। তাপপ্রবাহ চলাকালে বিশ্বজুড়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং জনস্বস্থ্য বিশেষজ্ঞরা শিক্ষার্থীদের গরম ক্লাসরুমে পড়াশুনা করা বা তাদের বাড়িতে থাকতে উৎসাহিত করা নিয়ে লড়াই করছেন। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে বিশ্বের প্রায় ১৭ শতাংশ স্কুল বয়সী শিশু ইতোমধ্যেই স্কুলের বাইরে রয়েছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনুপাতটি অনেক বেশি। সাব-সাহারান আফ্রিকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিশু যেখানে স্কুলের বাইরে সেখানে উত্তর আমেরিকায় এই হার মাত্র ৩ শতাংশ। উন্নয়নশীল বিশ্বে শিশুদের পরীক্ষার ফলাফলও উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেকে পিছিয়ে। বিশেষজ্ঞরা রয়টার্সকে বলেছেন, তাপপ্রবাহ শিশুদের পড়াশোনার মানকে আরো খারাপ করে তুলতে পারে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় উন্নয়নশীল দেশ এবং  উন্নত দেশগুলোর মধ্যে শেখার ব্যবধান দীর্ঘ করতে পারে। আমরা যদি আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোর কথা চিন্তা করি তাহলেই দেখতে পাবো বড় বড় শহরের বিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা গ্রামের বিদ্যালয়গুলো থেকে অনেক পিছিয়ে। এমনকি ঢাকা শহরের বিভিন্ন বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিখন ঘাটতি একটি থেকে আরেকটিতে আলাদা। এ নিয়ে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ আমরা দেখিনা। 

দক্ষিণ সুদানে মার্চের শেষের দিকে তাপামাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়ায় প্রায় ২২ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য তাদের স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফিলিপাইন ও ভারতের হাজার হাজার স্কুল এপ্রিলের শেষের দিকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ প্রায় তিন কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য স্কুল খোলা ও বন্ধ রাখার মধ্যে দোদুল্যমান রয়েছে। তাপমাত্রা বিপজ্জনক স্তরে উঠলেও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করার চাপের মধ্যে রয়েছে স্কুলগুলো। সেভ দ্য চিলেড্রেন-এর বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সুমন সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘দেশের অনেক স্কুলে পাখা নেই, বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ভালো নয় এবং এগুলোর টিনের ছাদ থাকতে পারে যা ভাল নিরোধক নয়। গত সপ্তাহে তাপপ্রবাহের কারণে বন্ধ হযে যাওয়া স্কুলগুলো খোলার একদিন পর ৩০ তারিখ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়েছিলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ আবারো প্রায় অর্ধেক জেলার (২৭ জেলার) সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে। 
 

শিক্ষার্থীরা তাপপ্রবাহের সময় ক্লাসে যোগ দিলেও তাদের শিক্ষার ক্ষতি হতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রা  মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপকে ধীরে করে দেয়, শিক্ষার্থীদের তথ্য ধরে রাখার এবং প্রক্রিয়া করার ক্ষমতাকে হ্রাস করে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি পরীক্ষার আগে উচ্চ তাপমাত্রার সংস্পর্শে আসে তবে তারা প্রমিত পরীক্ষায় আরো খারাপ ফল করছে। আমেরিকান ইকোনমিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতার শিক্ষাবর্ষ ওই বছরের শিক্ষাকে এক শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনের সহ-লেখক বোস্টন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ জশ গুডম্যান জানান, যেসব স্কুলে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিলো সেগুলোতে তাপপ্রবাহের বেশিরভাগ নেতিবাচক প্রভাব অদৃশ্য হয়ে গেছে। বিভিন্ন সমীক্ষা অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ স্কুলে অন্তত আংশিক শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে ।

নিম্ন আয়ের জেলাগুলোর স্কুল একাডেমিকভাবে তাদের ধনী জেলাগুলোর স্কুল থেকে পিছিয়ে রয়েছে। ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের সমীক্ষা অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বনিম্ন আয়ের শিক্ষার্থীদের গড় ফলাফল সর্বোচ্চ আয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে প্রায় চার বছর পিছিয়ে। গুডম্যান বলেন, যখন এই জায়গাগুলোর শিক্ষার্থীরা এক বছর বেশি তাপ অনুভব করেন, তখন মনে হয় তারা কম শিখেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন গরম ও শীতল দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষার ব্যবধানকে প্রশস্ত করবে। কিছু গবেষণায় দেখা যায়, গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে অতিরিক্ত তাপ জন্মের আগেও শিশুর শিক্ষাকে প্রভাবিত করতে পারে অর্থাৎ অনাগত শিশুর মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। 

তীব্র তাপের ফলে শিক্ষার্থীদের ওপর যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় যা তাদের শিখন ঘাটতি আরো বাড়িয়ে দেয়, বাড়িয়ে দেয় শিখন বৈষম্য। উন্নত বিশ্বে এসব নিয়ে গবেষণা হলেও আমরা এ বিষয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আছি। আমাদেরও বিভিন্ন এলাকার, বিভিন্ন ঋতুতে ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শিক্ষার ক্ষতি এবং ঘাটতি আমরা যাতে নিরূপণ করতে পারি সেই ব্যবস্থা সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে থাকা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবো না, আবার এই দুর্যোগের কারণে লেখপড়াও পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবো না, করা ঠিকও নয়। এই অবস্থায় কোন এলাকায় কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার সেটি আমরা  নির্ধারণ করতে পারি যদি  গবেষণা পরিচালনা করা হয়। 

লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক অধ্যাপক

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর - dainik shiksha শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী - dainik shiksha আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে - dainik shiksha জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ - dainik shiksha বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য - dainik shiksha এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা - dainik shiksha অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর - dainik shiksha ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন - dainik shiksha বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী - dainik shiksha একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003093957901001