রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলম মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামুদ্রিকবিষয়ক ইউনিটের সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন। দেশের সামুদ্রিক সম্পদের সম্ভাবনা ও সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে তিনি বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেসবাহুল হক
প্রশ্ন: ২০১২ এবং ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পর ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল অর্জন করে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সমুদ্র অর্থনীতি ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লাভবান হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাধা কোথায়?
খুরশেদ আলম: খুব টেকনিক্যাল বিষয় হওয়ায় সমুদ্রসীমা অর্জনের জন্য আগের সরকারগুলো তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দেন। ফলে স্বাধীনতার প্রায় ৩৫ বছর পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এরপর প্রায় দুই বছরের গবেষণায় সমুদ্রসীমায় কী ধরনের সামুদ্রিক সম্পদ রয়েছে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও তেমন সুফল আসেনি। কারণ বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে সাগর বা সমুদ্র নিয়ে যথেষ্ট দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। এ কারণে এখন পর্যন্ত সমুদ্র সম্পদ আহরণে খুব একটা দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এ খাতে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য সরকার মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। তাছাড়া কক্সবাজারে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মেরিন একাডেমির সংখ্যা বাড়ানো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দক্ষ জনবল পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন: মৎস্য সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন জানতে চাই।
খুরশেদ আলম: বর্তমানে বছরে প্রায় ৫ লাখ টন ইলিশ ধরা হয়। ইলিশ ছাড়াও সমুদ্রে অসংখ্য মাছ রয়েছে। আমাদের জেলেদের গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সক্ষমতা নেই। কাঠের নৌকা দিয়ে তীর থেকে সাগরের ৩০ মাইল পর্যন্ত মাছ ধরা সম্ভব। এ ছাড়া কিছু ট্রলারের মাধ্যমে আরও ৩০ মাইল পর্যন্ত মাছ ধরা হয়। মাছ ধরার জন্য কোনো জাহাজ নেই। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে টুনা মাছ ধরার জন্য ১৮টি জাহাজ কেনার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। লাইসেন্স পাওয়ার পরও কেউ একটি জাহাজও কেনেনি। অর্থাৎ বেসরকারি উদ্যোক্তারা খুব বেশি এগিয়ে আসছেন না। সরকার সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিচ্ছে।
প্রশ্ন: মাছ ছাড়াও সমুদ্রের নিচে তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য সম্পদ নিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কি?
খুরশেদ আলম: জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের ব্লু ইকোনমি সেল বর্তমানে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের বিষয়টি সমন্বয় করছে। ওই সেল নরওয়ের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সার্ভে সম্পন্ন করেছে। তেল-গ্যাসভিত্তিক আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছে তথ্য বিক্রির শর্তে প্রতিষ্ঠানটি ফ্রি সার্ভে করে দিয়েছে। এ সার্ভের পরই বেশ কিছু বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানি বাংলাদেশের সমুদ্রে তেল-গ্যাস খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সরকার আশা করছে, শিগগির সাগরের তেল-গ্যাস আহরণে পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
প্রশ্ন: সমুদ্র সম্পদের সুফল পেতে গবেষণার জন্য ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে একটি গবেষণা জাহাজ বা রিসার্চ ভেসেল কেনার উদ্যোগ নেয় সরকার। পরবর্তী সময়ে কী কারণে এ জাহাজ কেনা হয়নি?
খুরশেদ আলম: আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি চিন্তায় না নিয়ে তখন গবেষণার জাহাজের নামে অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ফলে ওই প্রকল্পে খরচ অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া ওই ধরনের জাহাজ পাওয়াও দুষ্কর। তাই ওই প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকায় মোটামুটি ভালোমানের গবেষণার জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে। সরকারও মনে করে এ ধরনের একটি জাহাজ প্রয়োজন। এ ধরনের জাহাজ ব্যবহার করে গবেষণা করার মতো দক্ষ জনবল এখনও গড়ে ওঠেনি। এ কারণে এ জাহাজ কিনতে সময় নিচ্ছে সরকার।
প্রশ্ন: সামুদ্রিক শৈবাল থেকে আগার-আগার উৎপাদনে একটি বাণিজ্যিক মডেল প্রস্তুত করেছে সরকার। এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।
খুরশেদ আলম: নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় সামুদ্রিক শৈবালের বাণিজ্যিক উৎপাদন নিয়ে গবেষণা চালানো হয়েছে। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের শৈবাল উৎপাদন বেশ লাভজনক। সরকার তো এ ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে পারে না।
বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করা হয়। কিছু উদ্যোক্তা বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে সবদিক থেকে যোগ্য একটি প্রতিষ্ঠানকে শৈবাল থেকে আগার-আগার উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, খুব শিগগির প্রতিষ্ঠানটি সামুদ্রিক শৈবালের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে পারবে।
প্রশ্ন: সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বাজেটে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
খুরশেদ আলম: বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে তথা পিপিপি ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তাছাড়া সরকার এ ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিজে করতে পারে না। তাই বাজেটে এ ক্ষেত্রে আলাদা বরাদ্দের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আগার-আগার উৎপাদনের উদ্যোগটি লাভজনক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাদের সাফল্য দেখেই অল্প সময়ে অন্যান্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এ খাতে বিনিয়োগ এগিয়ে আসতে পারে।
সূত্র : দৈনিক সমকাল