দক্ষ প্রশাসনের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো-মন্দ নির্ভর করে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এর মধ্যে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।

কিছুদিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল। এমনকি আন্দোলনকে পুঁজি করে সরকার হটানোর পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়। শনিবার (৫ মার্চ) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। 

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, ঢাকা থেকে লংমার্চও আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলন থেমে যাওয়ায় অনেকের মনোবাসনা অপূর্ণ থেকে যায়। আসলে আন্দোলনের কোনো ইস্যু না থাকলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারকে উত্খাত করার চেষ্টা করা খুব সহজ নয়, তা আবার প্রমাণিত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন অনেক কারণে হয়। ব্যবস্থাপনা ত্রুটি ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে অবহেলা এবং উপাচার্যদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে।

মোটাদাগে এই দুটি কারণে আন্দোলন দানা বাঁধে এবং তা দীর্ঘায়িত হয়। এর ফল ভোগ করেন শিক্ষার্থীরা। কোনো কোনো আন্দোলন দ্রুত শেষ হয়ে যায়। যেমন—ট্রাকের ধাক্কায় শিক্ষার্থী নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং চলমান বশেমুরবিপ্রবি এবং কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন হয়তো শেষ হয়ে যাবে। অতীতেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন আন্দোলন একটি পর্যায়ে এসে শেষ হয়ে গেছে; কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবির কোনো স্থায়ী সমাধান আমরা দেখি না। ফলে দেখা যায়, একই ইস্যু নিয়ে আবারও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামতে হয়। একেকটি ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলে শুধু সেই ঘটনাকে উপলক্ষ করে সমাধান দিলে কোনো স্থায়ী সমাধান আশা করা যায় না। কাজেই শিক্ষার্থী ও তাঁদের শিক্ষাজীবনকে সুন্দর করতে হলে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত দক্ষ প্রশাসন এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর। তাহলে আমরা স্থায়ী সমাধানের আশা করতে পারি।

এবার আসি উপাচার্যকেন্দ্রিক সমস্যার বিষয়ে। উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক। তিনি নির্বাহী প্রধান। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঘটনা ঘটলে তার দায় উপাচার্যের ওপর বর্তায়। তিনি যদি সৎ, দক্ষ ও ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকেন, তাহলে ধরেই নেওয়া হয় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তবে অনেক সময় সৎ হলেই চলে না, দক্ষতাও দরকার। আবার দুটি থাকলেও আমার অভিজ্ঞতা বলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। কেননা পেছনে অনেক বিষয় থাকে, যা মোকাবেলা করা কঠিন। তবে এ কথা সত্য, সৎ ও দক্ষ হলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সহজ।

যখন আমি এই নিবন্ধ লিখছি তখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ক্যাম্পাসের বাইরে। তিনি ক্যাম্পাস ছেড়ে কয়েক দিন আগে চলে গেছেন। আর যখন লেখাটি প্রকাশিত হবে তখন হয়তো উপাচার্য হিসেবে তাঁর আর মেয়াদ থাকবে না। তিনি আমাদের পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববদ্যািলয়ের উপাচার্য। যাঁরা নিয়মিত পত্রিকা পড়েন তাঁরা ঘটনাক্রম সম্পর্কে অবগত। কোন কোন অভিযোগের ভিত্তিতে অফিসাররা অফিস ভবনে তালা দিয়েছেন। এখানে সত্য-মিথ্যার প্রমাণ করছি না; কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, অতীতেও হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে উপাচার্যদের অফিসে ঢুকতে না দেওয়া। তাঁদের তালাবদ্ধ করে রাখা। কী এমন অপরাধ একজন উপাচার্য করেন যার কারণে তাঁকে অবরুদ্ধ করা হয়!

 

উপাচার্য একজন সিনিয়র শিক্ষক। তিনি মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেবেন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণার দিকে নজর দেবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোর উন্নতি ঘটাবেন এবং এ কাজ করার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাজে লাগাবেন। কিন্তু তিনি তা না করে অন্য পথে হাঁটলে সেখানে সমস্যা হবেই। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই হচ্ছে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন একজন শিক্ষার্থীর জীবন যায় কিংবা জীবনে কালিমা রোপিত হয়, তখন তার দায় কে নেবে। একজন উপাচার্যের জন্য যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিচে নেমে যায়, তখন এর দায় কে নেবে। একজন উপাচার্য দায়িত্বে থাকেন মাত্র চার বছর; কিন্তু তাঁর নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বোঝা আমাদের বহন করতে হয় বছরের পর বছর। কেননা একজন শিক্ষক ও অফিসার দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন।

যখন দেখি উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, তখন আমাদের খারাপ লাগে। হাতে গোনা দু-একজনকে অপসারণ করা হয়েছে। আমার জানা মতে, একমাত্র বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যকে আইনের আওতার আনা হয়েছিল। তাঁকে আদালতে এবং আমি যদি ভুল করে না থাকি জেলেও যেতে হয়েছিল। বাকিদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয় বা হতো, তাহলে উপাচার্যরা ভয়ের মধ্যে থাকতেন। কোনো অন্যায় বা অনিয়ম করার সময় দ্বিতীয়বার চিন্তা করতেন।

শুরুতেই বলছিলাম সঠিক ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও দক্ষ প্রশাসনের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক ভালো-মন্দ নির্ভর করে। আর যিনি এর কর্ণধার, তিনি উপাচার্য। তাঁকে হতেই হবে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ। এ কাজগুলো করতে পারলে শিক্ষার মান, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উন্নয়নে কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়। এমনকি দক্ষ প্রশাসন থাকলে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও কম থাকে, আর ঘটলেও তা মোকাবেলা করা সহজ হয়।

আমাদের এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক। সম্প্রতি আরো দুটি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অনুমোদন দিয়েছেন মন্ত্রিসভা। আমরা যদি আগামী দিনের শিক্ষার দিকে তাকাই, তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোন জায়গায় দেখতে চাই। অবশ্যই ভালো জায়গায় দেখতে চাই। তাহলে আমাদের দক্ষ নেতৃত্বের দিকে তাকাতে হবে। যদি কোনো অন্যায় ও অনিয়ম ধরা পড়ে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং আইনের আওতায় আনতে হবে। শুধু তদন্ত করে সুপারিশের মধ্যে অন্যায়কে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমাদেরও অনেক দায় আছে। উপাচার্যের মতো আমরা যাঁরা শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থী আমাদেরও অন্যায় আবদার ও দাবি পরিহার করতে হবে। তখন সহজ হবে উপাচার্যের অন্যায় প্রতিরোধ করা।    

লেখক : ড. নিয়াজ আহম্মেদ, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060420036315918