দখল দূষণে দিশাহারা সুন্দরী!

জাকারিয়া মন্ডল |

দিন যে দ্বিতীয় প্রহরে গড়িয়েছে তা বুঝে ওঠারই জো নেই। সকাল সাড়ে নটাতেও শীতলক্ষ্যার ওপরে জমাট বাঁধা কুয়াশা। এতো ঘন যে খুব বেশী দূর দৃষ্টি চলে না। শিমুলিয়া ঘাট থেকেও অনতি দূরের কাঞ্চন সেতুটাকে দেখা যাচ্ছে না। তার সামনে আবছা অবয়ব নিয়ে ভেসে আছে অস্ট্রিচ। বাংলাদেশের শতবর্ষী পাঁচটি পেডেল স্টিমারের একটি। পানির ওপর মাথা তুলে দুটি বড় বড় পেডেল স্রোত কেটে এগিয়ে চলে বলে এগুলোর নাম পেডেল স্টিমার। দ্রুতগতির কারণে এগুলো পরিচিত হয়ে ওঠে রকেট নামে। একসময় এগুলো চলতো ঢাকা-কলকাতা নৌরুটে। তারপর সদরঘাট থেকে মোরেলগঞ্জ।

এই ঐতিহ্যবাহী নৌযানে ভ্রমণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিশ্ববরেণ্য বহু ব্যক্তিত্ব। একসময় বিদেশি অতিথিদের রকেট স্টিমারে করে ঘোরানো ছিলো রাষ্ট্রীয় রেওয়াজ। এই অস্ট্রিচে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভ্রমণ কাহিনী এখনও নৌপথজীবীদের মুখে মুখে ফেরে।   

দুই পাশের পেডেলে বা পাখার কারণে এই শতবর্ষী অস্ট্রিচ ঝড়-বৃষ্টিতেও নিখুঁতভাবে ভারসাম্য ধরে রাখতে পারতো। এ কারণে কখনো দুর্ঘটনায়ও পড়েনি। কিন্তু, ২২৫ ফুট দীর্ঘ সেই অপরাজেয় জাহাজ আজ শীতলক্ষ্যার তীরে বাঁধা ভাসমান রেস্তোরাঁ। এ যেনো আমাদের নৌপরিবহনের বেহাল হয়ে পড়া বর্তমান দশারই মূর্ত চিত্র। 

একটু একটু করে কুয়াশা কাটার সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রিচের হতশ্রি চেহারাটা আরো প্রকট হতে থাকে। উল্টোদিকে উজানের জমাট কুয়াশা ভেদ করে ভেসে আসে ভট ভট ভট আওয়াজ। একটু পরই উদয় হয় একটা বাঁশবোঝাই ট্রলার। শান্ত শীতলক্ষ্যার ঘুম ভাঙিয়ে শীতল জল বেয়ে এগিয়ে চলে অস্ট্রিচের পাশ দিয়ে। তারপর ফের শান্ত শীতলক্ষ্যা। 

সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বনবিবির ইঞ্জিনও গর্জে ওঠে। নাক ঘুরিয়ে বাইতে শুরু করে শীতলক্ষ্যার উজান। পেছনে রোটরের ঘূর্ণিতে কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে শান্ত জল। একটু পরই কোথা থেকে যেনো উড়ে আসে একটা চিল। দলছুট চিলটা ডানা সোজা রেখে কিছুক্ষণ ভেসে থাকে বনবিবির পেছনে। হুট করে ড্রাইভ দেয়। কিন্তু, জলস্তরের কাছাকাছি পৌঁছে চকিতে মত পাল্টায়। ফের আগের স্থানে ফিরে উড়তে থাকে বনবিবির সঙ্গে সমান দূরত্ব বজায় রেখে। তারপর ফের ড্রাইভ, ফের ফিরে আসা। কয়েকবার চেষ্টা করেও বিফল চিল হারিয়ে গেলো বনবিবির উল্টোদিকে। শীতলক্ষ্যার কালো জলে কোনো মাছ জোটেনি তার। প্রাতরাশটা বুঝি আজ দেরিতেই হবে চিলটার!

এরই মধ্যে পৌষের আকাশে রোদ হাসতে শুরু করেছে। কুয়াশা মিলিয়ে পরিষ্কার হয়ে উঠছে নদীর বুক। কলকারখানার বর্জ্যে দূষিত শীতলক্ষ্যার জল এদিকে কালচে। একটু

উজানে বাঁ তীরে একটা ভ্যাসাল জাল। বাঁশের টোপে গুটিয়ে রেখে ফিরে গেছে জেলে। একটু আগের ওই চিলটার মতো এই নদীজীবীদের কাছ থেকেও যেনো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে শীতলক্ষ্যা। জীবিকার যোগান দেয় না আর। তাই জেলেপল্লী আর বেদেপাড়াগুলো সরে গেছে নদীর তীর থেকে। তাদের জায়গা এখন করপোরেট শিল্পপতিদের দখলে। যাদের কলকারখানার বর্জ্য প্রতিদিনই শীতলক্ষ্যার দূষণ বাড়িয়ে চলেছে। আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ জানালেন, এ নদীর অর্ধেকটাতেই দূষণকারী দেড় শতাধিক বর্জ্যের ধারা পেয়েছেন তারা। 

আরও সামনে শীতলক্ষ্যা যেখানে এস আকৃতির বাঁক নিয়েছে তার গোড়াতে নদীর বুকে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে ইঁট কাঁকরের স্তূপ। নদী দখলের বেপরোয়া প্রক্রিয়া। বিপরীতে নদী ভরাট করে জেঁকে বসেছে ইট ভাটা। গোটা চারেক চিমনি সমানে ধোঁয়া ছেড়ে চলেছে বাতাসে।

গোটা নদী পথটাতেই এমন চিত্র। ইটের ভাটা, কারখানা, ল্যান্ড ডেভেলপার কোম্পানির সাইনবোর্ড। নদীতীরের কাছাকাছি সারি করে গাঁড়া খুঁটিগুলোর দিকে আঙুল তাক করে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনির হোসেন বললেন-ওগুলো প্রাণ আরএফল কোম্পানির। রাতের বেলায় ট্রলিতে করে বালু এনে ফেলে। তারপর প্রাচীর দিয়ে হাপিস করে দেয় শীতলক্ষ্যার বুক। 

তার কথা সত্য প্রমাণ করে একটু সামনেই উদয় হলো নদীর বুক ভরাট করে গড়ে ওঠা একটা কারখানা। প্রাণ গ্রুপের সাইনবোর্ড দিব্যি নজরে এলো। এ সময় পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সেভেন রিংস সিমেন্ট কোম্পানির কার্গোটা জানিয়ে গেলো, এ নদীতে দখল আছে তাদেরও। আরো আছে আকিজ গ্রুপ, যমুনা গ্রুপের দলদারিত্ব, সামিট পাওয়ারের পাওয়ার প্ল্যান্ট। আরো অনেক করপোরেট জায়ান্টের দখলবাজি। নদীর বুকে ভেসে থাকা ভেসেলগুলো থেকে তেলের প্রকট গন্ধ নাকে আসছে। নদীর বুক দখল করেই কয়লার ডিপো গড়েছে তারা। মাঝেমধ্যে নামকাওয়াস্তে হওয়া উচ্ছেদ অভিযানে খড়গ এদের কাছে সবসময়ই ভোঁতা।  

ঘোড়াশাল সেতুর একটু আগে পরিষ্কার পানি হেসে উঠলো দুপুরের চিকচিকে রোদে। একটা শুশুক একটু পরপর ভেসে উঠছে নিজের খেয়ালে। তার পাশেই জাহাজ সারির ফাঁকে এক ঝাঁক সোনালী ডানার চিল। শীতলক্ষ্যার বুকে খাবার খুঁজছে। তার মানে, এখনো প্রাণ আছে শীতলক্ষ্যার উজান ধারায়। আর নদীটা যেহেতু বারোমাসি প্রবাহের, তাই কারখানাগুলো পাড় থেকে সরিয়ে নিলে শীতলক্ষ্যা নিজের রূপে ফিরতে পারবে। 

আমরা জানি, স্বচ্ছ সলিলা এই স্রোতস্বিনীর পানি অতি নির্মল ও সুস্বাদু হওয়ায় শীতলক্ষ্যা নামে অভিহিত হয় বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ যতীন্দ্রমোহন রায়। আর স্থানীয় জনশ্রুতিতে, যে নদীর পানি শীতল ও লক্ষ্মী, তারই নাম শীতলক্ষ্যা। এই লক্ষ্মী নদীর বিশুদ্ধ পানির খ্যাতি একদা ছড়িয়ে পড়েছিল জগৎজুড়ে। জাহাজে জাহাজে যেতো ‘পিওর শীতলক্ষ্যা ওয়াটার’– এর চালান। একসময় ইংল্যান্ডের কোম্পানিগুলো ওষুধ তৈরির কাজে এই নদীর স্বচ্ছ সুশীতল জল ব্যবহার করতো বলে বলা আছে জাতীয় তথ্য বাতায়নে।

মিথলজিতেও এ নদীর গুরুত্ব অনেক। যার ছাপ পরিস্ফূট জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতায়। ওই কবিতায় আরো অনেক চরিত্রের মতো নিজেকে ‘জমদগ্নি’ বলেও ঘোষণা করেছেন কবি। তারপর হয়েছেন পরশুরামের কুঠার। তিনি লিখেছেন-

….
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
,,,,
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
…. আনিব শান্তি শান্ত উদার!

পৌরাণিক আখ্যানে, এই জমদগ্নি একজন মহামুনি, আর পরশুরাম তার পুত্র। তিনি একদিন পুত্রকে ডেকে মাকে বধ করার আদেশ দেন। পিতৃভক্ত পরশুরাম তখনই সে আদেশ পালন করেন নিজের কুঠারের আঘাতে। এতে মায়ের মৃত্যু তো হয়, কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের হাতেই আটকে যায় কুঠারটি। শত চেষ্টাতেও তা ছাড়াতে না পেরে হতাশ পরশুরাম বেরিয়ে পড়েন ব্রহ্মপুত্র বা ব্রহ্মার পুত্রের খোঁজে। যার পবিত্র জলেই কেবল হতে পারে পাপমোচন। একসময় পর্বতের নিম্নদেশে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র হ্রদের সন্ধান পান পরশুরাম। তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর হাত থেকে ছুটে যায় কুঠার।

পরশুরাম তখন সেই হ্রদের পানিকে মহাপবিত্র জ্ঞান করে মর্ত্যে পৌঁছে দেওয়ার সংকল্প করেন। তারপর কুঠারটি লাঙলাবদ্ধ করেন। সেটিকে চালিত করেন পর্বতের মধ্য দিয়ে। সেই লাঙল পর্বত ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। ব্রহ্মপুত্রকে চালিত করে সমভূমিতে। লাঙলের গমন পথে তৈরি হয় নদী। সে নদীর নামও হয় ব্রহ্মপুত্র। আর লাঙল এসে যেখানে থেমে যায়, সে স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। সে স্থানের পাশ দিয়ে তখন যাচ্ছিলেন চঞ্চলা, যৌবনগর্বিতা, অনিন্দ্যসুন্দরী শীতলক্ষ্যা। তাঁকে দেখতে দুকূল ভেঙে ধাবিত হন ব্রহ্মপুত্র। 

প্রবল পরাক্রমশালী ব্রহ্মপুত্রকে দেখে ভীত শীতলক্ষ্যা নিজের রূপ লুকিয়ে বৃদ্ধার বেশ নেন। নিজেকে উপস্থাপন করেন বুড়িগঙ্গারূপে। ব্রহ্মপুত্র তাঁকে বলেন, ‘মাতঃ, শীতলক্ষ্যা কতো দূরে?’ জবাবে বৃদ্ধাবেশী বলেন, ‘আমারই নাম শীতলক্ষ্যা। আমি আপনার ভীষণ রবে ভীত হয়ে বৃদ্ধার বেশ ধারণ করেছি।’ এ কথা শুনে দ্রুত ধাবিত হয়ে শীতলক্ষ্যার অবগুণ্ঠন ছিঁড়ে ফেলেন ব্রহ্মপুত্র। তাঁদের মিলন হয়। এক স্রোতে মিশে যায় দুই নদী।

পৌরাণিক গল্পে, সেই থেকে প্রতি অশোকাষ্টমীতে ব্রহ্মপুত্র যখন তীর্থরাজ হয়, তখন পৃথিবীর সব তীর্থ, নদী বা সাগর তার কাছে আসে। লাঙ্গলবন্দে তখন পুণ্যস্নানের ঢল নামে। সেই লাঙ্গলবন্ধেও এখন পুণ্যস্থানের জল দূষণে কালো। আর সুন্দরী শীতলক্ষ্যা দখলে দূষণে দিশেহারা। তার রূপ উদ্ধারের সময় নিশ্চয়ই এখনো ফুরিয়ে যায়নি।

পাদটীকা
বছরের শেষ দিন শীতলক্ষ্যা নদীতে আয়োজন করা হয় ‘রিভার একশন গ্রুপ মিটিং ২০২৩’। যার আয়োজক ছিলো বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলা, রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্স সেন্টার-আরডিআরসি ও বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন-বিআরএফ। বনবিবি নামে এক নৌযানে দিনভর ভেসে শিমুলিয়া ঘাট থেকে ঘোড়াশাল সেতু পর্যন্ত পরিদর্শন করেন অতিথিরা। আলোচনায় খোঁজেন নদী বাঁচানোর কর্মকৌশল। এ সময় নদী রক্ষা বিষয়ক যে কোনো উদ্যোগে আইনি সহায়তা নিয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।  

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম - dainik shiksha ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় - dainik shiksha এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো - dainik shiksha প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027730464935303