ইউনূস ও ইব্রাহিমদণ্ডিত থেকে দণ্ডমুণ্ডের দুই কর্তা ও গেম চেঞ্জার

সিদ্দিকুর রহমান খান, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

ইব্রাহিম ও ইউনূস নাম দুটো শুনলেই ভক্তি আসে। নবীদের কথা মনে পড়ে যায়। বিশ্বব্যাপী মুসলমান পরিবারে নবাগত সন্তানের নামকরণে অপরাপর কয়েকটি নামের সঙ্গে এই দুটিও বহুল ব্যবহৃত। তাই ইব্রাহিম ও ইউনূস নাম দুটো আমাদের দেশেও খুবই কমন। তবে শুধু নামে মিল হলে তো চলবে না। কাজেও মিল থাকতে হবে। তবেই না আলোচনায় আসবে। আজকে আমরা যে ইব্রাহিম ও ইউনূসের নাম করবো তারা দুজনই গেম চেঞ্জার। উভয়েই স্বৈরাচারী শাসকের স্বেচ্ছাচারিতায় নিষ্পেষিত, নির্যাতিত, মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত। এদের একজন শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের রোষানলের শিকার। অপরজন সুদূর মালয়েশিয়ার সাবেক দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ও কথিতমতে বাংলাদেশী মাহাথির! এর নির্যাতনের শিকার। দু:সহ সময় জয় করে দুজনেই এখন নিজ নিজ দেশের সরকার প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত। এখানেই আজকের আলোচিত  ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও আনোয়ার ইব্রাহিমের অনন্য মিল!   

সংবিধান বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক এবং শেখ হাসিনা ও তার উচ্চপদে বসা নিম্নমেধার সাঙ্গপাঙ্গদের রোষে নির্যাতিত প্রয়াত মিজানুর রহমান খান ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেছিলেন। কুয়ালালামপুরে যেইমাত্র একজন ট্রাক্সিচালক জানলেন মিজানুর রহমান একজন বাংলাদেশী অমনি বললেন, আমাদের মাহাথিরও তো বাংলাদেশী।

পাঠক, মাহাথিরের বাংলাদেশ সংযোগের সংক্ষিপ্ত বিত্তান্ত জানতে মিজানুর রহমান খানের একটা লেখার খানিকটা উল্লেখ করছি। “মাহাথিরের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মীয়তার নৈকট্য আছে। তাঁর পিতামহ ভারত থেকে গিয়ে যে যুগে মালয় দ্বীপে বসতি গড়েছিলেন, তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা ভারতীয় ছিলেন। কুয়ালালামপুরের প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে অবশ্য এই গল্প (অসমর্থিত) বলতে পছন্দ করেন যে, মাহাথিরের দাদার বাড়ি চট্টগ্রাম। 

আনোয়ার ইব্রাহিম ইস্যুতে মাহাথিরকে পশ্চিমা গণমাধ্যম সাফল্যের সঙ্গে চিত্রিত করতে পেরেছিল যে, মাহাথির আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজেকে আসীন করতে পারলেও তাঁর উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি সংকটাপন্ন। তৃতীয় বিশ্বের গড়পড়তা কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকের কাতারেই তাঁর স্থান। উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোনো কুলীন নেতার মর্যাদা তার জন্য নৈবনৈবচ।”

আজ থেকে ছয় বছর আগে মিজানুর রহমান খানের লেখায় আরো পাই-  “তাই বলি, বাংলাদেশের গণমাধ্যম যখন মাহাথির-ম্যাজিককে বেশি বড় করে দেখছে, অগ্রজ সাংবাদিক কামাল আহমেদ ‘ম’ তে মাহাথিরের সঙ্গে ‘মারদেকা’ বা মুক্তি দেখেছেন, তখন পর্দার আড়ালের বাস্তবতা হলো, ইব্রাহিমই গেম চেঞ্জার। মাহাথির ও ইব্রাহিম  প্রমাণ করেছেন, ‘সমঝোতা’ কোনো ফ্যান্টাসি নয়। বিদেশি শক্তির দয়াদাক্ষিণ্যের চেয়ে জনতায় ভরসা রাখাই শ্রেষ্ঠতম বিকল্প। 

মাহাথির অকপটে স্বীকার করেছেন, তিনি ইব্রাহিমকে ফেলে দিয়ে ভুল করেছিলেন। সেটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছিল। সেই রাজনৈতিক ভুলের খেসারত দিয়েছেন তিনি। তবে সেটা মধুর। আনোয়ার বন্ধুবর মাহাথিরকে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর শর্তে প্রধানমন্ত্রী করে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রীর যোগ্যতা ও নেতৃত্বের প্রশংসা করতেই হবে। ইব্রাহিমের ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, ইব্রাহিমের স্ত্রী গোটা জাতীয় রাজনীতিতে একটি আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছেন। তিনি সেই ‘বিজয়লক্ষ্মী নারী’। আনোয়ারের স্ত্রী প্রমাণ করেছেন, উত্তরাধিকারের রাজনীতি মানেই হিংসার চাষাবাদ নয়, তিনি প্রমাণ রেখেছেন কীভাবে শুধু জনগণের শক্তির ওপর আস্থা রেখে কারারুদ্ধ স্বামীকে কাছে না পেয়েও পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনা যায়।’  

মিজানুর রহমান খানের লেখায় আরো পাই- “মাহাথির তাঁর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন, রাজা ইব্রাহিমকে ক্ষমা করে দেবেন। এটা কিন্তু একজন মাহাথিরের ঔদার্য নয়, এটা বন্দী ইব্রাহিমের অর্জন। যোগ্যতা থাকলে আইনের শাসনের সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া সম্ভব। মাহাথির হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি, যে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তিনি ইব্রাহিমকে কারাগারেই শুধু নয়, মাটিতে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই ইব্রাহিমেই তিনি শুদ্ধ হবেন। ইব্রাহিম তাবৎ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, জনগণের শক্তিতে বিশ্বাসী ও বলীয়ান হলে রাষ্ট্রক্ষমতা ও মর্যাদা পুনরুদ্ধারে জামিন লাগে না। কারাগারের ভেতরে কম আন্তরিক চিকিৎসাসেবাও কোনো সমস্যা নয়। নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা ইব্রাহিমের কারাগারের বাইরে চিকিৎসার আবেদন সরকার নাকচ করে চলছিল।”

পাঠক, আনোয়ার ইব্রাহিম ইস্যুতে মাহাথির কর্তৃক রাগ-বিরাগ, অনুরাগ ও ভুল সংশোধন এবং অনুতপ্ত হয়ে নেওয়া পদক্ষেপগুলো কমবেশি সবারই জানা। তবে, ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে মাহাথিরের মারাত্মক অন্যায় ও ভুলের মধ্যে ‘সমকামিতার’ অভিযোগ আনা অন্যতম। এটার সঙ্গে তুলনীয় না হলেও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা আনীত অন্যায় ও ভুল অভিযোগগুলো দেখে তার [হাসিনার] নিজ দলের বিবেকবান সমর্থক ও ঘনিষ্ঠদের কারো কারো রক্তক্ষরণ হতে শুনেছি। হাসিনা ঘনিষ্ঠ একজন পরামর্শ দিতে চেয়েছিলেন যে, ইউনূসের সঙ্গে যেনো কোনো নিষ্ঠুর আচরণ না করা হয়, কোনো মিথ্যা অভিযোগ আনা না হয়। সর্বশেষ পরামর্শ ছিলো, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যেনো ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জাতিসংঘের মহাসচিব করতে চিঠি দিয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়। এই পরামর্শ শুনে শেখ হাসিনা কি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন তা জানতে পারেনি বাংলাদেশের জনগণ। তবে, নিষ্ঠুরতার শেষ দিনগুলোতে লিফটবিহীন শ্রম আদালতে সশরীরে হাজিরা দিতে ৮৪ বছরের ইউনূসের কি যাতনা সইতে হয়েছিলো তা কিছুটা হলেও মানুষ বুঝতে ও জানতে পেরেছেন। এক প্রতিক্রিয়ায় ইউনূস বলেছিলেন, দেবী তার ওপর রুষ্ট হয়েছিলেন! আর সমকামিতার অভিযোগে শাস্তি দেওয়ার পর ইব্রাহিম কি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন তা আমরা জানতে পারিনি। দুই স্বৈরাচার মাহাথির ও শেখ হাসিনার নিষ্ঠুরতার শিকার আনোয়ার ইব্রাহিম ও ইউনূস গেম চেঞ্জার।

ওয়ান-ইলেভেনের পর সবকিছুতে ষড়যন্ত্র দেখছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আর সবকিছু হালাল দেখছিলেন শেখ হাসিনা। এবার ঠিক উল্টোটা। 

জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগী শেখ হাসিনা ও তার দল কি মাহাথিরের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে ড. ইউনূসের সরকারকে স্বাগত জানিয়ে, দলের দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিতে ইউনূস সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাবে? নাকি তিনি ও তার দল আরো বেশি প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে আজ থেকে বিশ-ত্রিশ বছর পর ড. ইউনূসের কবরে আগুন দেওয়ার দিয়াশলাইলের কাঠি বানানোর জন্য মাদার গাছ লাগাতে ব্যস্ত থাকবেন। 
শেখ হাসিনা ও তার দল যা-ই করুক না কেনো পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ড. ইউনূসের  ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইব্রাহিমকে আর মাত্র একদিন পরেই বাংলার মাটিতে দেখতে পাবো।

রোহিঙ্গা বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে অতিথি আনোয়ার ইব্রাহিমকে বিশেষ অনুরোধ জানাতে শুধু ঢাকা মাঠের খেলোয়াড়রা [দিল্লি কিংবা ইসলামাবাদ মাঠের নয়] প্রস্তুতি নেবেন?    


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি - dainik shiksha ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি ই-রিকুইজিশনের সংশোধন অপশন চালু - dainik shiksha ই-রিকুইজিশনের সংশোধন অপশন চালু এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক - dainik shiksha এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক শিক্ষা প্রকৌশলের প্রধান প্রকৌশলী রায়হান বাদশাকে ওএসডি - dainik shiksha শিক্ষা প্রকৌশলের প্রধান প্রকৌশলী রায়হান বাদশাকে ওএসডি পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উচ্চতর স্কেল পাচ্ছেন ২ হাজার ৯২৩ শিক্ষক - dainik shiksha উচ্চতর স্কেল পাচ্ছেন ২ হাজার ৯২৩ শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033559799194336