শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডট কম-এ গত ৪ঠা মার্চ প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিষয়ক সংসদীয় কমিটি মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়নে দাখিলের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের খাতা অন্য বোর্ডের শিক্ষক দ্বারা মূল্যায়নের সুপারিশ করেছেন। মাদরাসায় কর্মরত জেনালের শিক্ষকরা সংসদীয় কমিটির এই ‘বিতর্কিত’ সুপারিশে ক্ষুব্ধ এবং হতাশ হয়েছেন। এই সুপারিশের মাধ্যমে মাদরাসায় কর্মরত জেনারেল শিক্ষকদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:মাদরাসায় যোগ্য শিক্ষকের সংকট আছে : হানিফদাখিলের খাতা দেখানোর সুপারিশ বান্তবায়ন না করার দাবি শিক্ষকদের
দাখিলের খাতা মূল্যায়ন, যা বললেন ঢাবি অধ্যাপক বাহাউদ্দিন
উল্লেখ্য, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মাদরাসার দাখিল স্তরের শিক্ষকরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো এনটিআরসিএ’র পরীক্ষায় পাস করে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন। তাই দাখিলের খাতা অন্যবোর্ডের শিক্ষক দ্বারা মূল্যায়নের সুপারিশ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই সুপারিশ প্রত্যাহার করে নেয়াটাই যুক্তিসংগত হবে বলে মনে করি। অথবা সুপারিশটি পুনর্বিবেচনা করে এমন একটি গ্রহণযোগ্য সুপারিশ করা প্রয়োজন যাতে কোন শিক্ষক হেয় প্রতিপন্ন না হয় কিংবা অপমানিত বোধ না করেন। মাদরাসার জেনারেল শিক্ষকরা তাদের কর্মস্থলে যথেষ্ট দক্ষতা, আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন এবং তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। তাই এ ধরনের সিদ্ধান্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলেও করতে পারে। তাই মাদরাসার দাখিল স্তরের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত খাতা অন্য বোর্ডের শিক্ষক দ্বারা মূল্যায়ন করা হলে অন্যবোর্ডের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের খাতা মাদরাসার দাখিল স্তরের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দ্বারা মূল্যায়নের সুযোগ রেখে সংসদীয় কমিটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সুপারিশ করবেন এমনটাই প্রত্যাশা করি।
এছাড়া শুধু দাখিল পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে পরিবর্তন এনে মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হলে মাদরাসা শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন এবতেদায়ি স্তর জাতীয়করণ। এবতেদায়ি শিক্ষার্থীদেরকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো উপবৃত্তি দেয়া। মাদরাসার শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নের এই মূল নিয়ামকগুলোতে নজর না দিয়ে একটি প্রশ্নবিদ্ধ সুপারিশ করে শিক্ষকদের বিরাগভাজন হবেন না।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি মহোদয় বলেছেন, মাদারাসা শিক্ষার জন্য সরকার অনেক টাকা খরচ করে কিন্তু কাঙ্খিত ফল দেখতে পান না এবং আলিয়া মাদেসার শিক্ষার্থীদেরকে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ভূমিকা রাখতে দেখেন না। সংসদীয় কমিটির সভাপতি মহোদয়ের এই বক্তব্যে বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি এবং জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জনসহ বিসিএসে কৃতকার্য হয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করছে। আর সরকার যে টাকা মাদরাসায় ব্যয় করছেন তা আরও পরিকল্পিতভাবে ব্যয় করা প্রয়োজন।মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আরও কিছু নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন তাহলে মাদরাসা শিক্ষার্থীরাও দেশ ও জাতির কল্যাণে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
দৈনিক শিক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সভাপতি আরও বলেছেন, শিক্ষকদের মধ্যে নিজেদের চাকরির স্বার্থে শিক্ষার্থীদের পাস করানোর প্রবনতা দেখা যায়। সভাপতি মহোদয়ের এই বক্তব্যের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। শিক্ষকরা এমন কাজ করেন না বলেই আমি জানি। যদি কেউ করেও থাকেন, এর জন্য দায়ী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষা নীতি। এই সমস্যার সমাধান করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা বান্ধব ও শিক্ষক বান্ধব শিক্ষা নীতি এবং সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষার বৈষম্য দূরীকরণ।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি আরও বলেছেন, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধির কথা।
সভাপতি মহোদয়কে বলছি, শুধু সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন মাদরাসায় দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো এবং মাদরাসার প্রশাসনিক পদে জেনারেল শিক্ষকদের নিয়োগের ব্যবস্থা করা। একটি উদার জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা তৈরি করে মাদরাসার প্রশাসনিক পদে জেনারেল শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে একটি প্রতিযোগিতা মূলক প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল উগ্র সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ, তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার আধুনিকরুপ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে এবং মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়নে কারিকুলাম ও সিলেবাস আধুনিকায়ন করতে হবে, মাদরাসার প্রশাসনিক পদে পরিবর্তন করতে হবে, স্কুল-কলেজের আনুপাতিক হারে মাদারাসা জাতীয়করণ করতে হবে এবং দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে।
লেখক : মোঃ জহির উদ্দিন হাওলাদার, সভাপতি, বাংলাদেশ মাদ্রাসা জেনারেল টিচার্স এসোসিয়েশন।