কিছু যৌক্তিক দাবিদাওয়ার সঙ্গে কিছু কিছু অহেতুক দাবিতে রাস্তা অবরোধ, সাধারণ মানুষকে হয়রানি, তীব্র যানজট সৃষ্টি কিংবা জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলার পাঁয়তারা চলছে কি না তা সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত। সাবধানতা অবলম্বন না করলে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিতে পারে। হঠাৎ হঠাৎ এমন দাবি উত্থাপিত হচ্ছে যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে থমকে দিতে বাধ্য করছে। বর্তমানে সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি সার্বিক বিচারে তেমনি অযৌক্তিক মনে হচ্ছে।
কিছুদিন আগে অটোপাসের দাবিতে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের সচিবালয়ে প্রবেশ করে হট্টগোল বাঁধানোর ব্যাপারগুলোতে অন্যকোনো ইঙ্গিত আছে কি না খুঁজে দেখা দরকার। মোটামুটি কোমল বা নমনীয় সরকারের কাছে যা খুশি তাই চাওয়া যায়, যা ইচ্ছা তাই বলা যায়। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে জনগণ তো এমন জনবান্ধব সরকারের প্রত্যাশাই করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে গণ-আকাঙ্ক্ষা পূরণের যে সোপান রচিত হয়েছে তা ভবিষ্যতের পথ দেখাবে বলে আশা করছি। তবে ভদ্রতাকে দুর্বলতা ভেবে যারা কাঁধে ওঠার চেষ্টা করছে, কলিজায় খামচি দিচ্ছে তাদেরকে নিবৃত্ত করা না গেলে জাতির জাতীয় স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে চলার পথ ততোটা মসৃণ থাকবে না। এই যে চারদিকে দাবির রাজনীতি চলছে তাতে জনস্বার্থ কতোটুকু আর জনদুর্ভোগ কতখানি তা কি আন্দোলনকারীদের আদৌ বোধগম্য হচ্ছে?
নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের কাছে যেসব দাবি করার ফুরসত মিলতো না তা এখন অকপটে বলা যাচ্ছে। তবে এই নমনীয়তার সুযোগে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি কিংবা চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের একীভূতকরণের দাবি অথবা অন্য এমনসব দাবি তুলে সরকারে বিব্রত করা হচ্ছে কি না, যেগুলোর বাস্তবভিত্তিক বাস্তবায়নের কোনো গ্রহণযোগ্যতা-যৌক্তিতা নেই। রাষ্ট্রেরও তো কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। তা ছাড়া আনসারদের দাবির সঙ্গে ষড়যন্ত্রের গন্ধ, শ্রমিকদের দাবির নামে পতিত সরকারের মদদপুষ্ট পোশাক মালিকদের উস্কে দেয়া-এসব খবর তো জোড়ালোভাবে গণমাধ্যমে এসেছে। ষড়যন্ত্রের প্রমাণও মিলছে। সবচেয়ে বড় কথা, এমনসব দাবির কথা শোনার ফাঁদে সরকার পতিত হতে যাচ্ছে কি না যাতে তাদের অভীষ্ট সংস্কার থেকে তারা বিরত থাকতে বাধ্য হয়। এটা লক্ষ্যণীয়, যাত্রা শুরুকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে সরকারের শতদিন ঘুরতেই বিবৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। কোথাও কোথাও সন্দেহও দানা বেঁধেছে।
এ কথা স্বীকার্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভাষা নরম। জনতার স্বার্থের প্রশ্নে তাদের সুর দাবিপূরণের পক্ষে। দমন-পীড়নের চারপাশেও তারা ভিড়ছে না। লাঠি-বুলেট দিয়ে নয় বরং বাক্য দিয়ে বোঝাচ্ছে, আশ্বাস দিয়ে ঘরে ফেরাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চাপে ৫ আগস্ট সরকার পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়ার পরে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিলো তা এখন নেই বললেই চলে। পুলিশের মধ্যে সুশৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। প্রশাসনে রদবদলের ফলে কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জনতার দাবি এবং অসহিষ্ণুতা দূর হয়নি। কথায় কথায় আন্দোলনের ডাক দেয়া, কোনো দাবিতে রাজপথ দখল করা কিংবা আমাদের সরকার দাবি করে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেয়া-এমন চিত্র বাংলাদেশো নতুন অভিজ্ঞতার উদ্রেককারী। এক সময় টুঁ শব্দটিও করা যেতো না। যতোটুকুর পারমিশন মিলতো আন্দোলনের ভাষা-বিবৃতি ও অবস্থান ততাটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতো। জনতার দীর্ঘদিনের ক্ষোভ যখন লাগামহীন হয়েছে, বলার স্বাধীনতা মিলেছে কিংবা সমালোচনা ভাষা পেয়েছে তখন সে ন্যায্যতা-অধিকার সীমা মানছে না বরং বারবার সীমালঙ্ঘন করছে, যা অন্যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্ধারিত চ্যানেল ও কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সবার দাবি, পরামর্শ প্রদানের জন্য আহ্বান জানালেও কেউ কেউ তা মানছে না। দাবিদাওয়া জানানো, সরকারের কাছে কিছু চাওয়া কিংবা উষ্ণা প্রকাশ করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। এটা সাংবিধানিকভাবে স্ব স্ব স্বাধীনতার অংশ। কিন্তু কারো স্বাধীনতা পালনের নামে যদি অনেকের মৌলিক স্বাধীনতা ব্যাহত হয়, অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয় তবে সেটা অন্যায়। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা যদি যৌক্তিক ও প্রাপ্য মনে করে তবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দাবি জানাতেই পারে কিন্তু হুটহাট ছাওয়ালপাওয়াল নিয়ে রাস্তা দখল করা, ট্রেনের যাত্রীকে মেরে রক্তাক্ত করা, অসুস্থদের বহনকারী অ্যাম্বুলেস আটকিয়ে রাখা-এসব অনাচার। সরকারের উচিত রাস্তায় আন্দোলন এবং জনজীবন ব্যাহত করার মতো কর্মকাণ্ডের জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা। রাজপথে কোনো আন্দোলন করতে হলে সেটা অবশ্যই ছুটির দিনে-সেই নিয়ম মেনে হোক। তা ছাড়া কোনো কথা নাই, নিজেদের মধ্যে আলোচনা নেই কিংবা দাবি উত্থাপনের ঘোষণা নেই, সরাসরি রাজপথ দখল করে বসে পড়া-এমন ‘মগের মুল্লুক’ চলতে পারে না। এমন অরাজকতার পরিবেশ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। যে দাবি আদৌ বাস্তবায়নযোগ্য না সেই দাবিগুলোকে প্রশ্রয় দিলে দিনে দিনে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য বিশৃঙ্খলা বাড়বে। তাতে অন্তর্বর্তী সরকার যে মতামতের ম্যান্ডেট নিয়ে জনতাকে সংস্কারের স্বপ্ন দেখিয়েছ সেই সংস্কারগুলো দীর্ঘমেয়াদি যাঁতাকলে পড়বে।
কোন দাবিগুলো সরকারবিরোধীরা উস্কে দিচ্ছে, কোনগুলো বাস্তবায়ন অযোগ্য কিংবা কোন কোন সেক্টর নিয়ে সরকার কাজ করবে-সরকারের হাতে রোডম্যাপ থাকা দরকার। অধিক ভালো সাজতে গিয়ে বর্তমান সরকার ভবিষ্যতের সরকাগুলোকে এমন কোনো বিপদে যাতে না ফেলে যায় যাতে সেগুলোর বাস্তবায়ন ও ভরণ-পোষণ তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কোমলতাও যেমন সুশাসকের গুণ তেমনি কঠোরতাও সুশাসনের বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে এমন এমন দাবি পূরণের আলটিমেটাম উঠছে যা বাংলাদেশের বিগত ভালো-মন্দ কোনো সরকারের শাসনামলেই উত্থাপিত হয়নি। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের ভাবা উচিত ছিলো-সরকারি তিতুমীর কলেজকে যদি বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করতে হয় তবে তার আগে সামগ্রিক বিষয় (ক্যাম্পাস, ভবন, শিক্ষার্থী, অবস্থান, আয়তন) বিবেচনায় আরো অন্তত ২০ বা ততোধিক কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তন করতে হবে। চুক্তিভিত্তিকদের স্থায়ীকরণ, গ্রেড পরিবর্তন, একই সার্ভিসে ক্যাডার-নন ক্যাডার দ্বন্দ্ব, আন্তক্যাডার দ্বন্দ্ব, ডাক্তার-প্যারাম্যাডিক্যালের দ্বন্দ্ব এইসব নিয়ে আন্দোলনের যৌক্তিক সময় এখন নয়। এমনকি বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন করেও সরকারকে বিব্রত করার মোক্ষম সময় এটি নয়। রাষ্ট্রের স্বার্থে সরকারকে আরো বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের সুযোগ দেয়া উচিত। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার বারবার বাংলাদেশে আসবে না। কাজেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন হবে সেটার গতিপথ ঠিক করিয়ে রাখা দরকার।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসিত হোক বা না হোক, সামনের নির্বাচনে বিএনপি বা জামায়াত ইসলাম-যারাই ক্ষমতায় আসুক কিংবা বাংলাদেশ অপ্রত্যাশিত কোনো ভাগ্যবরণ করুক-অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ যতো বাড়বে রাজনৈতিক দলগুলো ততো বিরূপ হয়ে উঠবে এবং নির্বাচন আয়োজনের জন্য তাড়াও দেবে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ক্ষমতা ছেড়ে দূরে থাকা সহজ নয়। কাজেই অল্প যে কয়টি দিন, মাস বা বছর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আছে সেদিনগুলোতে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সরকার ফ্যাসিবাদে পরিণত হতে না পারে। আমলা-পুলিশ দলদাস ও দস্যূতার দোসরে পরিণত না হয়। দেশটা লুটেরাদের সুবর্ণভূমিতে পরিণত না হয়। লুটপাট, সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সাধারণের জীবনে হাপিত্যেশ আর না ফিরুক। সেজন্যই আপাতত এমন কোনো আন্দোলন-দাবি দানা বাঁধতে দেয়া যাবে না, যা সরকারের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থতির উদ্রেক করে। এজন্য ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসানাত প্রমুখকে জোড়ালো ভূমিকা নিতে হবে। তৃতীয়পক্ষ যে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার ফাঁদে সরকারকে ফেলতে চাচ্ছে তা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র-জনতাই ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারকেও আইন করে রাস্তা দখল, সচিবালয় ঘেরাও এবং সাধারণ মানুষকে রোজ রোজ বিপত্তিতে ফালানোর কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। কখনো কখনো কঠোরতাও সার্বিকভাবে মঙ্গলের।
লেখক: প্রাবন্ধিক