সৌরভ কুমার শীলের জন্ম সরকারি জায়গায় তোলা ছোট দোচালা টিনের ঘরে। ছোটবেলায় তার পড়াশোনা শুরু অন্যের বই-খাতা ধার করে। বাবা শ্যামল কুমার শীল রাস্তায় ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। একসময় তিনি ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন।
এরপর সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় সৌরভকে। তিন বছর ধরে বাবার চায়ের ফ্লাস্ক হাতে নিয়ে সারা দিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করে সে। এই সৌরভ ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছে গোল্ডেন এ প্লাস (জিপিএ ৫)।
সৌরভ নাটোরের সিংড়া পৌর শহরের বাস টার্মিনাল এলাকার (মাদারীপুর গ্রাম) শ্যামল কুমার শীল ও স্বপ্না রানী শীলের ছেলে। সৌরভের মতো দারিদ্র্যকে জয় করে এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে আরো দুই শিক্ষার্থী। তারা হলো নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার চকতকিনগর গ্রামের দিনমজুর জামাল উদ্দিন ও ঝরনা বেগমের মেয়ে জিতু আক্তার এবং টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে বাকপ্রতিবন্ধী সাজ্জাদ হোসেন। তবে এই তিন শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারে আনন্দের মধ্যে ছায়া ফেলেছে আর্থিক সংকট। আর্থিক সংকটের কারণে তারা কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে কি না, দুশ্চিন্তায় রয়েছে।
লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তা
নাটোরের সিংড়া দমদমা পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল সৌরভ কুমার শীল। বাবা শ্যামল কুমার শীল বলেন, ‘আমাদের কোনো জায়গা-জমি নেই। সরকারি জায়গায় ছোট্ট একটি ভাঙা ঘরে ঠাঁই। রোদ-বৃষ্টিতে অনেক কষ্ট করতে হয়। বর্তমানে ছেলের উচ্চশিক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। ’
স্থানীয় মিজানুর রহমান ও মারুফ হোসেন জানান, তাঁরা প্রায় প্রতিদিন চায়ের ফ্লাস্ক হাতে সৌরভকে বাসস্ট্যান্ড, বাজার, চলনবিল গেট এলাকায় দেখেন। তাঁরা বুঝতে পারেননি যে সৌরভ এত মেধাবী ও পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। তাঁরা চান, সামর্থ্যবানরা সৌরভের পাশে দাঁড়ান।
সিংড়া দমদমা পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম আনু বলেন, ‘সৌরভ কুমার শীল অত্যন্ত মেধাবী। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে তার লেখাপড়া ফ্রি করানো হয়েছে। সৌরভের গোল্ডেন এ প্লাস জয়ে আমরা আনন্দিত। ’
সৌরভের স্বপ্ন সে লেখাপড়া করে প্রকৌশলী হবে।
স্বপ্নপূরণে বাধা
নাটোরের বাগাতিপাড়ার তমালতলা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছে উপজেলার চকতকিনগর গ্রামের জিতু আক্তার। একই প্রতিষ্ঠান থেকে জেএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল সে। শত প্রতিকূলতায়ও জিতুর পড়ালেখায় ছেদ পড়েনি। কিন্তু এখন তার স্বপ্নপূরণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্থিক সংকট।
জিতুর এক ভাই আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী, অন্যজন শিশু শ্রেণিতে পড়ে। বাবা জামাল উদ্দিন দিনমজুরের কাজ করে কোনোমতে সংসার চালান। এর ওপর তাদের পড়ালেখার খরচ চালানো প্রায় অসম্ভব। জিতু আক্তার বলে, সে ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চায়। তাই শহরের ভালো কোনো কলেজে পড়াশোনা করতে চায়। কিন্তু বাবা-মায়ের সে সামর্থ্য নেই।
তমালতলা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাজনীন সুলতানা বলেন, ‘জিতু আক্তার অত্যন্ত মেধাবী। সে দারিদ্র্যকে জয় করে লেখাপড়া করছে। দোয়া করি, সে যেন মানুষের মতো মানুষ হয়ে সমাজের সেবা করতে পারে। ’
সাজ্জাদের এসএসসি জয়
টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার মসিন্দা চেঁচুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ৩.৫৬ পেয়েছে বাকপ্রতিবন্ধী ছাত্র সাজ্জাদ হোসেন। সাজ্জাদের বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে দুই বছর ধরে বাড়িতে বেকার পড়ে আছি। আগে ভ্যানগাড়ি চালাতাম। এখন কৃষিকাজ ও খড় কেনাবেচা করে সংসার চালাই। আমার দুই ছেলের মধ্যে বড় সাজ্জাদ। সে পাস করায় আমি আনন্দিত। পরিবার নিয়ে চলা আমাদের পক্ষে খুব কষ্টকর। সরকারি সহযোগিতা পেলে উপকার হতো। ’
সাজ্জাদ ইশারায় বুঝিয়েছে, সে অত্যন্ত খুশি। আরো লেখাপড়া করতে চায়।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রতন কুমার দত্ত বলেন, ‘সাজ্জাদ হোসেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমাদের বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তাকে আমরা বিনা বেতনে পড়াই। শুধু বোর্ড ফি দিয়ে ওকে এবার এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করে দিই। ও সরকারি তালিকাভুক্ত প্রতিবন্ধী কিশোর। শত কষ্টের মধ্যেও সে পাস করায় আমি খুব খুশি। ’
কালিহাতী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তফা কবীর বলেন, সাজ্জাদ কালিহাতীর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে চাইলে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের হুসেইন বলেন, ‘সাজ্জাদ লেখাপড়া করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত থাকবে, এটাই চাই। সাজ্জাদের পরিবারের খোঁজ নিয়ে তাকে যতদূর সম্ভব সহযোগিতা করার উদ্যোগ নেব। ’
টাঙ্গাইলের সরকারি মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের অধ্যক্ষ শহীদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বা ব্যক্তিরা সমাজের বোঝা নয়। আমাদের তাদের পাশে থেকে উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে। সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে তাদের অংশগ্রহণ করাতে হবে। তবেই দেশ-জাতির কল্যাণ হবে।