দূর থেকে আসা কওমি মাদরাসার কয়েক শিশু শিক্ষার্থী

রুম্মান তূর্য |

দিনের শেষ প্রহর। খবরের ব্যস্ততা তুঙ্গে। কর্মমুখর নিউজরুমে হঠাৎ ছন্দপতন।  কেউ একজন বলেছেন, ‘মাদরাসা ছাত্রদের জন্য কিছু সহায়তা দিন’। 

সব কী বোর্ডের আওয়াজ থেমে গেলো হুট করে। সংবাদকর্মীরা প্রবেশ পথের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত এক কিশোর দাঁড়িয়ে। বয়স খুব বেশি হলে ১৫ বছর। তাকে শিশু বলাই শ্রেয়। তার হাতে চাঁদার রশিদ বই। পেছনে আরো তিন নিষ্পাপ চেহারা। কারো বয়সই ১৬ পার হয়নি।

ছাত্র-শিক্ষকদের ও শিক্ষার জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়া দেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তার নিউজরুম জুড়েই থমকে আছেন সংবাদ কর্মীরা। একটু আধটু জিজ্ঞাসায় জানা গেলো, তারা এসেছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে। ফতুল্লার কাশিপুর এলাকার জান্নাতুল বাকী নূরানী হাফিজিয়া মাদরাসা এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের ছাত্র সবাই। এক শিক্ষক বা ছাত্রদের ভাষায় হুজুর তাদের রাজধানীর কারওয়ান বাজারে তহবিল সংগ্রহের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে তিনি নিচে আছেন। ঢাকা ট্রেড সেন্টারের পাঁচতলায় দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষাডটকমের অফিসে পাঠিয়েছেন তার শিশু-কিশোর ছাত্রদের। 

সাধারণত দেশের কওমি মাদরাসাগুলোর কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংবাদকর্মীদের কথা বলতে দেন না। তাই নিউজরুমে তাদের পেয়ে সে সুযোগ হাতছাড়া করার ইচ্ছে হলো না। 

কিছুক্ষণ কথা বলে জানা গেলো, তহবিল সংগ্রহে কারওয়ান বাজার এলাকার বেশ কয়েকটি অফিসে তারা যাচ্ছেন, সাহায্য চাচ্ছেন। 

ওই ছাত্ররা জানালেন, জান্নাতুল বাকী নূরানী হাফিজিয়া মাদরাসা এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং থেকে তারা হাফেজ হবেন। তবে হুজুর বা শিক্ষকরা বলেছেন, যা যা প্রয়োজন হবে তা নিজেদের সংগ্রহ করে নিতে হবে। তাই তারাই নারায়ণগঞ্জ থেকে সঙ্গে করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এসেছেন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। শিক্ষার্থীরা সংগ্রহ করছেন তহবিল। 

ওই চার ছাত্র জানালেন, তাদের দুজন রংপুর, একজন দিনাজপুর ও একজন কুমিল্লার বাসিন্দা। পরিবার ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের মাদারাসায় লেখাপড়া করছেন। রংপুরের বাসিন্দা এক ছাত্র জানালেন, তিনি আগে দাখিলে পড়াশোনা করতেন। সেখানেও টাকা লাগতো না। তবে তাঁর রিকশাচালক বাবা তাকে নারায়ণগঞ্জের এই মাদরাসায় ভর্তি করিয়েছেন। এখানে থাকা-খাওয়া ফ্রি। 

মাসে কতোদিন এরকম তহবিল সংগ্রহ করতে হয় জানতে চাইলে ছাত্ররা বললেন, যখন প্রয়োজন হয়। এখন আমাদের কিছু পাঞ্জাবি ও কিতাব (বই) প্রয়োজন। তাই তহবিল সংগ্রহে এসেছি। শিক্ষার্থীরা জানালেন, মাদরাসাগুলো মূলত পরিচালিত হয় দান-অনুদানের ওপর। যা সংগ্রহ করতে হয় শিক্ষার্থীদেরই। দানের খরচেই চলে ছাত্রদের খাবার। 

মাদরাসায় কি খাবার দেয়া হয় জানতে চাইলে ছাত্ররা বললেন, সকালে আলু ভর্তার সঙ্গে ভাত। দুপুরে ভাতের সঙ্গে দেয়া হয় মাছ বা ডিম। আর রাতে সবজি-ভাত। তবে কেউ অনুদান বাবদ খাসি অন্য কিছু দিয়ে গেলে সেদিন ভালো খাবার মেলে পাতে। আর মাঝেমাঝে শুক্রবার স্থানীয়দের উদ্যোগে মাদরাসায় ভালো খাবার দেয়া হয়। 

মাদরাসাগুলোকে কী পড়ানো হয় জানতে চাইলে তারা বললেন, শুধু ধর্মীয় বিষয়। হাফেজ তৈরিতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। বিজ্ঞান, গণিত বা হিসাববিজ্ঞান বিষয় সম্পর্কে হুজুররা (শিক্ষক) তাদের কিছু বলেন না। 

মাদরাসায় শিক্ষকরা ছাত্রদের মারধর করেন কি-না জানতে চাইলে হঠাৎ নীরব হয়ে যান চার ছাত্রই। কিছুটা সময় নিয়ে একজন বলেন, পড়াশোনার জন্য শাসন হিসেবে যতোটুকু দরকার মনে করেন ততোটুকু শাসন করেন হুজুররা। এক ছাত্রকে প্রশ্ন করা হয়, বড় হয়ে কি হতে চান। তিনি বলেন, হুজুরই হতে চাই।

শিশু-কিশোরের দলটিকে কিছু চাঁদা দিয়ে বিদায় জানানোর পর রশিদে উল্লেখিত মুঠোফোনে কল করা হয় জান্নাতুল বাকী নূরানী হাফিজিয়া মাদরাসা এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। একজন কল রিসিভ করে নিজেকে শিক্ষক কাউছার বলে পরিচয় দেন। মাদরাসার প্রধানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ওই ফোনটিই দেন অপর একজনকে। মওলানা ইমরান পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তি নিজেকে ওই মাদরাসার প্রধান বলে দাবি করেন। তিনি জানান, মাদরাসার ছাত্ররা ঢাকায় গিয়েছিলো, সঙ্গে কালেক্টর শিক্ষক ছিলেন। তবে কোথায় গিয়েছিলো তা তিনি জানেন না। কালেক্টর শিক্ষকের দায়িত্ব কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাদরাসায় কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তহবিল সংগ্রহে পাঠানো হয় ওই শিক্ষককে।      

মাদরাসা প্রধান পরিচয় দেয়া ওই ব্যক্তি জানান, তিনি তিন সন্তানের জনক। মাদরাসা থেকে কোনো বেতন না নিলেও তার পরিবারের খরচ চলে মাদরাসার অর্থে। মোট ৬ জন শিক্ষক আছেন মাদরাসায়। কিশোর ছাত্রদের তহবিল সংগ্রহে পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষক সঙ্গে ছিলেন। তবে শিক্ষককে ছাত্রদের সঙ্গে পাওয়া যায়নি জানালে তিনি কোনো উত্তর দেননি। 

মাদরাসার খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৪৫ জন শিক্ষার্থী আছেন মাদরাসায়। তাদের খাবারে প্রচুর খরচ হয়, তাই তহবিল সংগ্রহে ছাত্রদের পাঠানো হয়েছে। মাদরাসার খরচ কিভাবে চলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাদরাসার ৭-৮ একর জমি আছে, সেগুলোতে চাষাবাদ হয়। আর স্থানীয় বিভিন্ন অনুদান আসে। তহবিল সংগহের সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্ররা কোনো জটিলতায় পড়লে সে দায় মাদারাসা কর্তৃপক্ষ নেবে কি-না জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
 
প্রসঙ্গত, কওমি ও হাফিজিয়াসহ অনিয়ন্ত্রিত মাদরাসাগুলোর এমন পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত দেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। বিশিষ্টজনদের পক্ষ থেকেও নানা সময় কওমি মাদরাসাকে মূলধারায় নিয়ে আসার তাগিদ দেয়া হয়েছে। তবে কওমি ধারার হর্তাকর্তারা একাডেমিক অবকাঠামোয় আসার বদলে দানের টাকায় চলতে একাট্টা অবস্থান নিয়েছেন।  

সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে মতবিনিময় হয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক ও বিশিষ্টজনদের। ওই অনুষ্ঠানে সিনিয়র সাংবাদিক রাশেদ আহমেদ কওমি শিক্ষার্থীদের মূলধারার শিক্ষায় নিয়ে আসার তাগিদ দিয়ে বলেন, কওমি শিক্ষার্থীদের উৎপাদনশীলতা দেশের কতোটা কাজে লাগছে সেটা ভেবে দেখতে বলবো। যদি তাদের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার মধ্যে নিয়ে আসা না যায়, মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসা না যায়, তাহলে কোনো না কোনো সময়ে এটি বড় একটি বোঝা হয়ে যেতে পারে আমাদের দেশে। 

সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর) আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক মেরিনা জাহান কবিতা বলেন, কওমি শিক্ষার্থীরা এখনো বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বাইরে আছেন। তাদের বাদ রেখে পুরো জাতিকে এগিয়ে নেয়া যাবে না।

ওই অনুষ্ঠানে কওমি মাদরাসা নিয়ে অসহায়ত্বের সুর শোনা যায় খোদ শিক্ষা ব্যবস্থার অভিভাবক শিক্ষামন্ত্রীর কণ্ঠে। তিনি বলেন, কওমি মাদরাসায় এখনো আমরা (নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে) প্রবেশ করতে পারিনি। তবে আমরা আশা করি, নতুন শিক্ষাক্রম ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা নিয়ে আমরা সেখানে প্রবেশ করতে পারবো। ধীরে ধীরে কওমি মাদরাসাকে মূলধারার শিক্ষায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হবে। 

তবে মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেও কওমি মাদরাসা শিক্ষক পরিষদ সভাপতি অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী পীর সাহেব দেওনা এক বিবৃতিতে বলেন, কওমি মাদরাসাকে মূলধারায় আনার কথা হতাশাজনক ও উস্কানিমূলক। 
তিনি বলেন, আমরা শিক্ষামন্ত্রীকে স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দিতে চাই, তার এই বক্তব্য আইনবিরোধী। কারণ, ‘আল হাইয়াতুল উলইয়া লিলজামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীনে ‘কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান প্রদান আইন, ২০১৮’ (২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪৮ নং আইন)-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘কওমি মাদরাসাগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা বজায় রেখে দারুল উলূম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরে পরিচালিত হবে। মাদরাসা পরিচালনা ইত্যাদিতে প্রভাবমুক্ত থেকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখবে।


7

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অবশেষে বাজারে আসছে একাদশ শ্রেণির পাঁচ আবশ্যিক বই - dainik shiksha অবশেষে বাজারে আসছে একাদশ শ্রেণির পাঁচ আবশ্যিক বই অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে রেলগেট অবরোধ তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে রেলগেট অবরোধ তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে - dainik shiksha আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে - dainik shiksha ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি - dainik shiksha কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002856969833374