দেশাত্মবোধক শিক্ষা নেই বলেই বিপথগামী কওমি শিক্ষার্থীরা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশাত্মবোধবহির্ভূত শিক্ষা ব্যবস্থায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ধর্মান্ধ হয়ে বিপথগামী পদ বেছে নিচ্ছে। হেফাজতের আড়চোখা অন্তর্দৃষ্টিতে একটি ‘ইসলামিক অভ্যুত্থান’ সংঘটনের পরিকল্পনার গুজব শোনা যায়। প্রথিতযশা রাজনীতিবিদের চরম শূন্যতায়ই অপরিণামদর্শী উঠতি নেতাদের উত্থান ঘটেছে। এদেশে ইসলামিক অভ্যুত্থান কোনোদিনই সংঘটিত হবে না। আর ইসলামিক রিপাবলিকান অব বাংলাদেশের স্বপ্ন দিবাস্বপ্ন থেকে যাবে।

রাজনীতিবিদের সোৎসাহে বলতে ইচ্ছে করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম অর্থাৎ ষাট ও সত্তর দশকের রাজনীতিবিদরা আপনারা ফুরিয়ে গেছেন। এজন্য ডাকসাইটে থেকে এখন সাইড লাইনে। মুক্তির সংগ্রামে আপনারা একটি সুশীল বিদগ্ধ স্বাধীনতাকামী প্রগতিশীল শ্রেণিকে পেয়েছিলেন। তাদের ওতপ্রোত অংশগ্রহণ ও সমর্থন সমরসম্মুখে যোদ্ধারূপে পেয়েছিলেন। ফলে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের তিন গ্রুপ কাউন্সিল-কনভেনশন ও কাইয়ুম মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামি পার্টি এবং এমনকি পীর মাওলানার দৌরাত্ম্য রুখে দিতে পেরেছিলেন। নরহত্যা ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে ধৃত হতে হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২২এপ্রিল)  ভোরের কাগজ পত্রিকার প্রকাশিত এক নিবন্ধে তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পট পাল্টে গেছে। আওয়ামী লীগের শত্রুদের জড়ো করা সহজ হয়েছে। রাজাকারদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সফল হওয়া গেছে। স্বাধীনতার বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রিত্ব, মন্ত্রী, এমপিত্ব দিয়ে জিয়াউর রহমানের পক্ষে ক্ষমতা ধরে রাখা অনেকটা সহজও হয়েছিল। কারণ এসব স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, আব্দুল আলীম, বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, এ আর ইউসুফ বঙ্গবন্ধুর জমানায় ডাকসাইটে নেতাও ছিলেন। কিন্তু এসব ভয়ংকর মৌলবাদীদের চেয়েও বর্তমান ধর্মান্ধ মৌলবাদী মহাভয়ংকর। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতৃত্ব আশাপ্রদ নয়।

সংবিধান প্রণয়নকালে ওসমানী বঙ্গবন্ধুকে মাদ্রাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতক পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের একটা অধ্যায় সন্নিবেশিত করে দিতে বলেন। মাদ্রাসাসহ ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন বাধ্যতামূলক করতে বলেন এবং তা সাংবিধানিকভাবে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাবিদদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সেই কাজটি সম্পাদন করতে পারেননি। বরং বঙ্গবন্ধু ওসামানীকে বলেন, ‘মাই ডিয়ার সিনিয়র ফ্রেন্ড আমি এটা করতে গেলে বুদ্ধিজীবী পণ্ডিতরা ময়দান গরম করে ফেলবে।’

যাই হোক, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কওমি মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয় না। জাতীয় সংগীত পরিবেশন হয় না। বরং ১৯৭৬ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সিরাতুননবী সম্মেলন ডেকে তৎকালীন নৌপ্রধান এমজি তোয়াব ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ নামকরণ, জাতীয় সংগীত পাল্টানোর প্রস্তাব করে ঔদ্ধত্য দেখান।

জাতীয় পতাকায় সবুজের মাঝে লাল যে বৃত্ত সেটাকে সোনালি রঙে অঙ্কিত করে সরকারি ভবনে উত্তোলনও করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের তীব্র কর্মসূচির মুখে তা বাদ দেয়া হয়। এই তোয়াব বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে আপসরফা করে দেন। তাদের বিদেশের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক চাকরি পাইয়ে দেন জিয়াউর রহমানের নির্দেশে। কিন্তু খুনি ফারুক চক্রের সঙ্গে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থান করতে গিয়ে কুপোকাত হন তোয়াব।

মৌলবাদীদের বিএনপি মোড়কে উত্থান ঘটে। ফলে প্রজন্মটি স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানসপটে ধারণ করতে পারেনি। নিহত হলে শেখ মুজিব হয়ে যান মরহুম রাষ্ট্রপতি। রাতারাতি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা খেতাব নিষিদ্ধ হয় সংবাদপত্রে। রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে সরকারি অনুমোদন দিতে হয়।

অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধীরা সংগঠিত হতে থাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত ভরকে যায় এবং তারা চারদলীয় জোট গঠন করে। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত মন্ত্রীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। জামায়াতের নেতারা ফাঁসিতে নির্মূল হওয়ায় মৌলবাদীদের উত্থান ঘটে নতুন মোড়কে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাহলে আমাদের শিশু-কিশোরদের মানস-গঠন হবে কি করে? আমাদের শিশু-কিশোররা ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের মন্ত্রতন্ত্রে কতটা বেড়ে উঠেছে তার প্রতিফলন আমরা শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবে প্রত্যক্ষ করেছি।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে কেন্দ্র করে। আসা ঠেকাতে পারেনি কিন্তু হেফাজতের তাণ্ডবে ১৮/১৯ জন তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। আর্মির গাড়িকেও অবরুদ্ধ করে রাখার পেশি শক্তি দেখিয়েছে। সোনারগাঁয় রিসোর্টে মামুনুল হকের কেলেঙ্কারি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ।

তার অসংলগ্ন কথাবার্তা ধর্মভীরু মানুষকেও আহত করেছে। ইসলাম ও কুরআনের অপব্যাখ্যা দিয়ে তিনি এখন শ্রীঘরে। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে হেফাজতের চেহারা দেখা মিলছে না। যারা সোনারগাঁয় রিসোর্টে মামুনুল হকের কুকীর্তিকে ন্যায়সঙ্গত মনে করে তাণ্ডব চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারাও এখন গ্রেপ্তার হয়েছেন। সবাই হেফাজত নেতা। কই সেই লাখো মানুষের ঢল?

অনেকে হেফাজত থেকে পদত্যাগও করেছেন। মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী ২৭ বছরের শিশুবক্তাও এখন শ্রীঘরে। আমি এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর একটি কথার। তিনি সাংবিধানিকভাবেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে মুক্তিযুদ্ধের ও স্বাধীনতার ইতিহাস সন্নিবেশিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন।

৪৬ বছর পর ২০১৭ সালে কওমি মাদ্রাসাকে যখন শেখ হাসিনা সমমর্যাদার দান করলেন, তখন শ্রদ্ধেয় বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম লিখেন, সরকারের প্রতি দাবি করেন, কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি শেখ হাসিনার যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এখন সরকারের উচিত হবে, কওমিসহ সব মাদ্রাসায় ‘জাতীয় পতাকা’ উত্তোলন ও ‘জাতীয় সংগীত’ পরিবেশনের নির্দেশনা জারি করা। শিক্ষার্থীদের তবেই মানসপটে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হতো।

লেথক: সোহেল সানি,সাংবাদিক ও ইতিহাস বিশ্লেষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032000541687012