সালটা ১৯৮৭। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে ভর্তি হয়েছি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। ভর্তি-সূত্রে আমি শাহ মখদুম হলের ছাত্র। ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে উঠেছিলামও এই হলে। ছাত্রত্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। নানান স্মৃতি, নানান অভিজ্ঞতা, আনন্দ-বেদনার ঘটনা আজও আমাকে নাড়া দেয়। সেদিনকার সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেক ঘটনা আজ হঠাৎ করেই বেশি বেশি আলোড়িত করছে আমাকে। সম্ভবত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অন্যায়-অপকর্মের অভিযোগ আমাকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করছে। মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রাখার আগে থেকেই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বেশ গভীর। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তা আরও জোরদার হয়। সেই সূত্রে ছাত্ররাজনীতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, ক্যাম্পাসভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির আড্ডা, আবুর ক্যান্টিনের আড্ডা, ক্যাফেটেরিয়ার জমজমাট আসর, মানিকের শিঙাড়ার দোকানে জমিয়ে গল্প করাসহ কোনো কিছু থেকেই নিজেকে বঞ্চিত করিনি। পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে শহীদ মিনার, সাবাস বাংলাদেশ, লিচুতলা, শহীদুল্লাহ ও মমতাজউদদীন কলাভবনের সামনের ফাঁকা জায়গা এবং রবীন্দ্রভবনের সামনের অংশে অনুশীলন, সমকাল, তীর্থক, আবহমান-এর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আমাকে এবং আমার মতো হাজারো শিক্ষার্থীকে প্রভাবিত করত ব্যাপকভাবে। আর এভাবেই প্রগতিশীল ভাবধারা আমাদের মধ্যে আসন গেড়ে বসেছে।
পাশাপাশি প্রফেসর আলী আনোয়ার, গোলাম মোর্শেদ, আবুল ফজল হক, আ. ন. সামশুল হক, সনৎকুমার সাহা, শহীদুল ইসলাম, হাসান আজিজুল হক, জুলফিকার মতিন, আব্দুল খালেক, সাইদুর রহমান খান প্রমুখ সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের জীবনাচরণ, আচার-ব্যবহার, কথা বলার ভঙ্গি ও উপস্থাপনা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, অন্ধ ও কুসংস্কার বিরোধী বক্তব্য, সত্য প্রচারের আপ্রাণ চেষ্টা, মৌলবাদবিরোধী প্রচার, সামাজিক ঘটনাবলির জটিল অথচ সহজবোধ্য বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্নেষণ আমাদের উৎসাহিত করেছে, উজ্জীবিত করেছে এবং যুগোপযোগী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রাণশক্তির সঞ্চার করেছে। তারা আমাদের কাছে ছিলেন বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, বন্ধু, পরিচালক এবং লৌকিকতাবর্জিত জড়তাহীন মুক্তাচরণ আদর্শ শিক্ষক। প্রায় চার বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য এবং তার দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের অত্যাচার ও অপশাসনের ভয়াবহতা ও করালগ্রাসের মধ্যে থেকে মনে হচ্ছে একটা মাৎস্যন্যায় অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছি।
ছাত্রজীবনের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবধারার কিছুই যেন এখন আর অবশিষ্ট নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই স্বাদ, গন্ধ এবং সঙ্গ আজ ভুলতে বসেছি। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অনেকেই অনেক ধারণা দিতে পারেন। তবে ১৯৪৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সর্বজন শ্রদ্ধেয় জওহরলাল নেহরু এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, তা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা প্রদান করে। তিনি বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হলো সেই প্রতিষ্ঠান, যেখানে মানবতাবাদ, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, সত্যানুসন্ধান, নতুন নতুন জ্ঞান অন্বেষণ, অনুসন্ধান, গবেষণা, দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা, ইচ্ছা ও বুদ্ধির মুক্ত চর্চা সদগুণ এবং মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের শিক্ষা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসব বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের জাগ্রত করতে পারলেই কেবল জাতি হিসেবে আমরা শক্তিশালী হবো, অন্যথায় নয় (অনীল বরণ রায়, স্টুডেন্টস অ্যাকটিভিজম ইন ইন্ডিয়া)। আমরা এখন ছাত্রজীবনের সেই বিশ্ববিদ্যালয় অথবা জওহরলাল নেহরুর দর্শনতাড়িত বিশ্ববিদ্যালয় চাই। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে রূপ-চেহারা দাঁড়িয়েছে, সেরকম বিশ্ববিদ্যালয় চাই না। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য যেমন প্রজ্ঞাবান আদর্শ শিক্ষক প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন একজন দক্ষ উপাচার্য ও তার দক্ষ প্রশাসন।
তাহলে প্রশ্ন জাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কেমন উপাচার্য চাই? উপাচার্যের কী কী গুণ থাকা প্রয়োজন? তারা কি বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুস সোবহানের মতো হবেন? নাকি আমাদের সেই ছাত্রজীবনের রোল মডেল শিক্ষকদের মতো হবেন?
ইদানীং উপাচার্য হওয়ার লোভে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, মঙ্গল-অমঙ্গল, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বাছবিচার করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে বসেছেন। নিজের যোগ্যতাকে যথেষ্ট মনে না করে বাবা, ভাই, মামার মতো লোকজনকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে অথবা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করছেন না। কোনোমতে উপাচার্য পদে আসীন হতে পারলে এসব শিক্ষক নীতি-নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা ইত্যাদি ভুলে যাবেন। তবে, সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদী এসব ব্যক্তি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রকৃতিস্থতা হারিয়ে তোষামোদি করতে যে উন্মাদ হয়ে যাবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সবিনয়ে জানাতে চাই যে, এমন কাউকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেবেন না, যিনি শুধু উপাচার্য হওয়ার জন্যই উন্মাদ হয়ে আছেন, আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছেন, আপনাদের স্তুতি গাইছেন, নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে যেমন তেমন রাজনৈতিক নেতার পেছনে ঘুরতে কোনোরূপ দ্বিধাবোধ করছেন না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তার সময়ে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের জন্য নিজে প্রফেসর আব্দুল মতিন চৌধুরী, এ আর মল্লিক, খান সারওয়ার মুর্শিদ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের খুঁজে বের করে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
আসলে জাতি ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষা ব্যবস্থাকে কলুষমুক্ত করা প্রয়োজন। আপনাদের প্রতি অনুরোধ, সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে আপনারা উপাচার্য বাছাই করুন। ধান্দাবাজ, সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী, চাটুকার ও দুর্বৃত্তদের উপাচার্য পদে নিয়োগ দেবেন না। আমরা চাই এমন বিশ্ববিদ্যালয়, যার শিক্ষক-শিক্ষার্থী সচেতন হবেন, পরিবর্তনশীল বিশ্বে নেতৃত্ব দেবেন, উন্নত জাতি ও দেশ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে নির্দি্বধায় কাজ করবেন। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা, পরিবর্তন আনতে সক্ষম, দক্ষ, চতুর্মুখী নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের প্রতি আস্থাশীল, রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের রোল মডেল, সৃষ্টিশীল, অভিজ্ঞ একাডেমিশিয়ান, প্রতিষ্ঠিত গবেষক, একসঙ্গে অনেককে নিয়ে কাজ করার মানসিকতাসম্পন্ন, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বডিকে শক্তিশালী করার মনোভাবাপন্ন এবং '৭৩ অধ্যাদেশকে সমুন্নত রাখবেন এমন কাউকে বাছাই করুন। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে বদ্ধপরিকর এমন একজনকে বাছাই করুন, যিনি জাতির পিতার আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এমন কাউকে খুঁজে বের করা কঠিন নয়। আর এ দায়িত্ব অবশ্যই আপনাদেরকেই নিতে হবে।
লেখক : এস. এম. এক্রাম উল্যাহ, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়