দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক : দেশের মোট শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ তরুণ-তরুণী। তাদের মধ্যে শিক্ষিত তরুণদের প্রায় অর্ধেকই বা ৪২ শতাংশ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। অনিশ্চিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, দক্ষতা অনুযায়ী চাকরির বাজার তৈরি না হওয়া, গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের স্বল্পতা, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগের অভাব এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা শঙ্কার কারণেই তাদের এ আগ্রহ। তবে বিদেশ যাওয়ার পর যদি দেখেন এসব সংকট সমাধান হয়েছে তাহলে ৮৫ শতাংশই আবার দেশে ফিরে আসার কথা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে ২০২৩’ শীর্ষক যৌথ সমীক্ষায় বিষয়টি উঠে এসেছে। বাংলাদেশের যুবসমাজের অবস্থান, সমসাময়িক ভাবনা ও প্রত্যাশা জানতে বিওয়াইএলসি পাঁচ বছর পরপর জাতীয় নির্বাচনের আগে এ সমীক্ষা পরিচালনা করে। বিওয়াইএলসি কার্যালয়ে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এবারের তথ্য উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাপক আবুল খায়ের সজীব ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের সাবেক গবেষণা সহযোগী হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম। জীবিকা, জলবায়ু পরিবর্তন, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সুশাসন, তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিপ্রায় বিষয় এ জরিপের ফলাফলে তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বেগ—দুটিই উঠে এসেছে।
দেশের আট বিভাগের ৫ হাজার ৬০৯ তরুণ-তরুণীর মাঝে পরিচালিত এ জরিপে দেখা যায়, ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশই দেশ ছাড়ার কারণ হিসেবে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেছেন। ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ আবার মনে করেন, তাদের যে দক্ষতা রয়েছে দেশে সে অনুযায়ী চাকরি নেই। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই মনে করেন ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ মনে করেন দেশে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ কম। এছাড়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কারণে দেশ ছাড়তে চাইছেন ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ-তরুণী।
দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুবাশ্বিরা তাসনিম। নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিদেশ যেতে চাই। কেননা দেশে সফল হতে হলে মেধার চেয়ে বেশি মূল্যায়ন পায় লবিং, নেপোটিজম। মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আরো অনেক বেশি। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা, বাইরেও নিরাপত্তার অভাব। নারীরা চাকরি করবে, উদ্যোক্তা হবে, ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করবে এসব সিদ্ধান্তের কথা যখন পরিবারকে জানানো হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। তবে দেশ ছেড়ে উন্নত বিশ্বে স্থায়ী হয়ে একই কাজগুলো করলে পরিবারের কোনো আপত্তি নেই। তাই দেশ ছেড়ে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার কথা ভাবছি।’
জরিপে অংশ নেয়া ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ বিশ্বাস করেন বর্তমানে দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা নেই। অপরদিকে ৬৩ শতাংশ তরুণ মনে করেন গত পাঁচ বছরে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছেন ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ। এছাড়া ২৯ শতাংশ তরুণ মনে করেন দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার হ্রাস পাচ্ছে, যা সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করছে।
দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যায় স্নাতক শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ওবায়দুর রহমান।তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের দেশে সেক্টরভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই নগণ্য। অধিকাংশ সেক্টরে মেধার মূল্যায়ন করা হয় না। মেধাবী শিক্ষার্থীদের শেখা এবং জানার অন্যতম প্রধান মাধ্যম গবেষণা। অথচ আমাদের দেশে এর জন্য ফান্ডিং নেই বললেই চলে। গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা অনুযায়ী চাকরির বাজারও সংকীর্ণ। আবার দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। তাছাড়া সামাজিক সুরক্ষার অভাব তো রয়েছেই।’
বিওয়াইএলসি জরিপে দেখা যায়, জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশী তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণই ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হতে চেয়েছেন। শিক্ষার মানোন্নয়নেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন তরুণরা। জরিপে অংশ নেয়া ৫৭ দশমিক ৭ শতাংশই মনে করেন এক্ষেত্রে শিক্ষকের মান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ বিশ্বাস করেন পাঠ্যক্রমে নেতৃত্বচর্চা ও সফট স্কিল উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ যুক্ত করে শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব।
ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভের রিসার্চ লিড হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে যাতে তরুণদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে, সেজন্য নির্বাচনকে সামনে রেখে এ জরিপটি পরিচালিত হয়। সমীক্ষার ফলাফলে তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বেগ উভয়ই উঠে এসেছে। ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে তারা নিরাপদ বোধ করেন না। তরুণদের মত প্রকাশের জন্য আরো নিরাপদ আবহ তৈরি করা যে কতটা জরুরি এ তথ্য তাই জানান দেয়।’
তরুণদের শুধু ভবিষ্যতের কাণ্ডারি হিসেবে দেখলেই চলবে না, বরং সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারণী কাজে যুক্ত করতে হবে বলে মনে করেন বিওয়াইএলসির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সভাপতি ইজাজ আহমেদ। তিনি বলেন,”‘যুবকদের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তাদের মতামত কেবল জাতীয় নীতিমালায় যুক্ত করলেই হবে না; রাজনীতি, ব্যবসা, বেসামরিক খাত এবং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বচর্চার ক্ষেত্রও তৈরি করে দিতে হবে।’
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সিপিজের গবেষণা পরিচালক ড. এম সানজীব হোসেন বলেন, ‘আমি তরুণদের নিয়ে ভীষণ আশাবাদী। এদেশের তরুণদের মধ্যে যে আশার শিখা আমি দেখতে পেয়েছি তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এখন এটা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব আমাদের রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের।’
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সিপিজের গবেষণা সহযোগী তাসনিয়া খন্দকার ও বিওয়াইএলসির নির্বাহী পরিচালক তাহসিনাহ আহমেদ।