দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা ও উচ্চ কক্ষের নাম জাতীয় পরিষদ, নিম্ন কক্ষ সংসদ। সংসদ নির্বাচন হবে প্রচলিত পদ্ধতিতে তিনশত আসনে। জাতীয় পরিষদের ২০০ আসন হবে। সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে বণ্টন হবে। আইন সভার মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কেউ দুবারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কমিশন গঠনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হাজির করা হয়েছে। শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ল রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) এর সাবেক সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সালেহ উদ্দিন এই খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন।
খসড়া প্রস্তাবের উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এম. আসাদুজ্জামান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিচারপতি এম. এ মতিন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বিচারপতি, আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
প্রস্তাবনায় বলা হয়, জাতীয় পরিষদের সদস্যসংখ্যা হবে ২০০। তারা জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসাবে অভিহিত হবেন। তাদের মধ্যে ৬৪ জন নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ১২ জন নির্বাচিত সিটি করপোরেশনের মেয়র, ২৫ জন সংরক্ষিত মহিলা এবং ১০ জন ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ২৫ জন সংরক্ষিত নারী সংসদ-সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে নির্বাচিত হবেন। অবশিষ্ট ৮৯ জন জাতীয় সদস্য নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে নির্বাচিত হবেন। এরূপ বণ্টনের ফলে যে রাজনৈতিক দল আনুপাতিক হারে যত আসন পাবে, এর ভিত্তিতে তারা মনোনয়ন দেবে। তবে শর্ত থাকে, রাজনৈতিক দলগুলো যত আসন পাবে, এর অর্ধেক সদস্য নিজ দলীয় সদস্যদের মধ্যে থেকে, বাকি অর্ধেক সদস্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করবে। তবে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন না। সংরক্ষিত অপর ১০ জনকে রাষ্ট্রপতি সরাসরি মনোনয়ন দেবেন। এ মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যতদূর সম্ভব সমতাবিধান করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্র্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের প্রতিনিধি নিশ্চিত করবেন।
খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, জাতীয় পরিষদ হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ও আইনপ্রণয়ন সভা, যা অর্থনৈতিক নীতি, জাতীয় নিরাপত্তা নীতি, বৈদেশিক সম্পর্কের নীতি এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিকাশে পথরেখা প্রণয়ন করবে। জাতীয় বাজেট (অর্থবিল) ছাড়া জাতীয় সংসদে পাস হওয়া আইন চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে জাতীয় পরিষদ।জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপনের ছয় মাস আগে জাতীয় পরিষদে প্রাক-বাজেট আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় পরিষদের মেয়াদ হবে চার বছর।
জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা থাকবে ৩০০। কোন সংরক্ষিত মহিলা আসন থাকবে না। তবে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে দশ ভাগ নারী সদস্যকে মনোনয়ন দিতে হবে। সরকার গঠন, সরকারের প্রতি অনাস্থা এবং অর্থ বিল পাসের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে থাকবে। এর বাইরে রাষ্ট্রের সকল আইন প্রণয়ন জাতীয় সংসদের প্রাথমিক অনুমোদনের পর জাতীয় পরিষদ চূড়ান্ত অনুমোদন দিবে। জাতীয় পরিষদ এবং সংসদ নিজেদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিজেরাই বৃদ্বি করতে পারবেন না। কোন শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবেন না। তাদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির আবেদন সাংবিধানিক আদালত বিবেচনা করবে।
প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দণ্ড হতে পারে-এমন অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে আদালতের অনুমতি ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। তবে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত করবে-এমন সন্দেহজনক কোনো ব্যক্তি ছাড়া কাউকে আটক রাখা যাবে না। তবে সন্দেহের উপযুক্ত ভিত্তি থাকতে হবে। আদালতে হাজিরের সময় প্রতিবেদনে উপযুক্ত কারণ উল্লেখ করতে হবে। অহেতুক হয়রানি করা যাবে না। আদালতের অনুমতি ছাড়া নাগরিকের গৃহে প্রবেশ ও তল্লাশিতে পুলিশের অধিকার থাকবে না।
জাতীয় পরিষদের যে সব রাজনৈতিক দলের অরাজনৈতিক সদস্য আছেন তাদের এক জন করে প্রতিনিধি নিয়ে 'নির্দলীয় ত্বধাবধায়ক সরকার গঠন' বিষয়ক একটি সার্চ কমিটি গঠিত হবে। ওই কমিটিতে সংসদের সরকারি দলের নেতা এবং বিরোধী দলীয় নেতা অথবা তাদের একজন করে প্রতিনিধি থাকবেন। জাতীয় পরিষদের অধ্যক্ষ এই সার্চ কমিটির সভাপতি হইবেন। তাহারা ঐক্যমতের ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের একজন নির্দলীয় সদস্যকে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে এবং পনের জন উপদেষ্টার মধ্যে দশ জন নির্দলীয় জাতীয় পরিষদ সদস্যকে উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবেন। সুপারিশ পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা এবং দশ জন উপদেষ্টাকে নিয়োগ দিবেন। তারা ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টা ও দশ উপদেষ্টার তালিকা চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হলে কমিটির সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে ।
প্রধান উপদেষ্টা এবং দশ জন উপদেষ্টা নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা অন্যান্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে অবশিষ্ট পাঁচ জন উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিতভাবে সুপারিশ করবেন। তারা জাতীয় পরিষদ অথবা জাতীয় সংসদের নির্দলীয় সদস্যদের মধ্য থেকেও হতে পারবেন অথবা আইনসভার বাইরে সমাজের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের মধ্য থেকেও হতে পারবেন। তবে তাদের কেউই কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন না। জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি সাংবিধানিক আদালত থাকবে। সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত একজন প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এবং হাইকোর্টর দুইজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নিয়ে এই আদালত গঠিত হবে। সাংবিধানিক আদালতে কেউ মামলা দায়ের করতে পারবেন না।
সংবিধানের কোন ব্যাখ্যার প্রশ্ন উত্থাপিত হলে রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পরিষদ অধ্যক্ষ ও স্পিকার সাংবিধানিক আদালতের মতামত গ্রহণ করতে পারবেন। এমনকি নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনের কোন চাহিদা পূরণে অনীহা দেখালে কমিশন সাংবিধানিক আদালতে অভিযোগ করতে পারবে।
উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ দেবে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কমিশন। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশনে সদস্য হবেন আইনমন্ত্রী, আপিল বিভাগের একজন এবং হাইকোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক। অ্যাটর্নি জেনারেল, আইনজীবী সমিতির সভাপতি, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এবং সরকারি ও বিরোধী দল ও জাতীয় পরিনষদের অধ্যক্ষ মনোনীত একজন করে সদস্য থাকবেন।
প্রজাতন্ত্রের কোন কর্মকর্তা এবং প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ভোটের অধিকার নিয়ে কোন ষড়যন্ত্র করলে কিংবা ভোট প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটের ৫০ ভাগ প্রদত্ত না হলে নির্বাচন বাতিল হবে এবং পুনরায় দুই মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। জন্মসূত্রে বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক দেশে ১৮ বছর পর্যন্ত বসবাস করলে জাতীয় সংসদ ও জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অযোগ্য হবেন না।
রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক ও গঠনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কমিটি গঠন হয় কিনা তা নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত করবে। রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন বা ছদ্মনামে কোন সংগঠন থাকবে না। কার নিকট হতে চাদা গ্রহন করা হয় তার তালিকা এবং আয় ব্যয়ের হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশ করবে।
সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহন রেখে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কাউন্সিলের প্রধান হবেন রাষ্ট্রপতি। সরকার প্রধান, আইন সভার অধ্যক্ষ, স্পিকার, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, তিন বাহিনী প্রধান এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব কাউন্সিলের সদস্য হবেন।
সরকারের প্রতি আস্থা-অনাস্থা ভোট এবং অর্থ বিল ছাড়া আর সকল কিছুতে স্বাধীনভাবে মত প্রদান ও ভোট দেওয়ার অধিকার আইন সভার সদস্যদের থাকবে।