বাজার নিয়ন্ত্রণ, বাজারে খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ একটি জটিল চেইন। এই চেইনের কোথাও কোনো বিঘ্ন ঘটলে পুরো ব্যবস্থার ওপরই তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে আর তার পুরোটাই ভোগ করতে হয় জনগণকে বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষদের। ফলে, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও এই বিষয়টি পুরো ঘোলাটে করে ফেলে। মানুষকে খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে, তারপর তার অন্যান্য কাজ। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবনকে নাকাল করে দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছেনা নিত্যপণের দাম। তার অর্থ এই নয় যে, উৎপাদনকারী কিংবা কৃষক এই ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে লাভবান হচ্ছেন। যে শাকের দাম রংপুরের গ্রামে বা বাজারে ৫ থেকে ১০ টাকা সেই শাক ঢাকায় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এর কারণ ব্যবসায়ীদের এবং ব্যবসায়ীদের যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের অজানা নয়। সেই জানা জায়গাগুলোতে হাত দিতে হবে। হঠাৎ কারওয়াবাজারে এসে দ্রব্যমূল্যের দাম লিখে দেয়া কিংবা দাম কমাতে বলা বোধ হয় সঠিক পদক্ষেপ নয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে যেভাবে কষ্টে ফেলে দেয় তেমনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ডেকে আনে অমানিষা। আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় বর্তমানে পশ্চিবঙ্গ মেদিনীপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যায় এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। একইসঙ্গে বন্যার কারণে গোটা বাংলার আমন মৌসুমের চাল উৎপাদন নিয়ে তৈরি হয় বড় ধরনের আশঙ্কা। বাংলা ও আশপাশের প্রদেশগুলোয় চালের দাম বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবেশি বিহারের গভর্নর সেখান থেকে পারমিট ছাড়া অন্যান্য প্রদেশে চাল সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর মধ্যেই চালের উৎপাদন নিয়ে বাংলার প্রাদেশিক সরকারের কৃষিমন্ত্রী ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহর এক বক্তব্য আবার অস্থিতিশীল করে তোলে চালের বাজারকে। মজুদ প্রবণতা বাড়তে থাকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
স্টেটসম্যান পত্রিকায় সে সময় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে বাংলায় প্রতি মন চালের গড় দাম ছিলো ৫ রুপি। ওই বছরের অক্টোবরের মধ্যে কলকাতার বাজারে চালের মনপ্রতি দাম ১০ রুপি ছাড়িয়ে যায়। মার্চের শেষদিকে এসে তা ২০ রুপি অতিক্রম করে। একইসঙ্গে রংপুরের বাজারে প্রতি মণ চালের মূল্য দাঁড়ায় ২৯ রুপিতে। কুমিল্লায় তা বিক্রি হচ্ছিলো ২৩ রুপিতে। আর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম বাজারে প্রতি মণ চালের দাম ৩০ রুপি ছাড়িয়ে যায়। গোটা বাংলায় দুর্ভিক্ষ তখন মাত্র জেঁকে বসেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় চাপে পড়ে যায় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন সরকার। দ্রুত জনপ্রিয়তা কমতে থাকে তার। পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে গভর্নরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলার বিরোধ। প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলিতে তার বিরুদ্ধে তোলা হয় অনাস্থা প্রস্তাব। সে ফাঁড়া অল্পের জন্য কাটাতে সক্ষম হলেও গভর্নরের সঙ্গে বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মার্চ পদত্যাগ করতে হয় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে। রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন কারণ দ্রুত তিনি জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন।
একমাসের মাথায় নতুন সরকার গঠন করেন খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ। সে সময় তার উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে শেরেবাংলা বলেছিলেন, যদি চালের দাম বাড়ার জন্য ফজলুল হক মন্ত্রিসভা দায়ী হয়, তাহলে পারলে খাজা নাজিমুদ্দিন তা কমিয়ে দেখাক। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনা গোটা বিষয়টিতে আরো বিপর্যয় ডেকে আনে। ওই সময় যুদ্ধের জন্য বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ চাল সরিয়ে নেয়ার কারণে বাজারে সরবরাহ সংকটের আশঙ্কা স্বীকার করতে চাচ্ছিলোনা ব্রিটিশ সরকার। এজন্য প্রাদেশিক সরকারগুলোকে বিশেষ করে বাংলাকে বলা হয় সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও পর্যাপ্ত বলে প্রচার করতে। সেসময় বাংলা সরকারের সরবরাহমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। দিল্লি ও লন্ডনের মতো তিনিও শুরুতে বাংলায় চালের সরবরাহ পর্যাপ্ত বলে দাবি করেন।
তার শুরুর দিকের পদক্ষেপগুলোতেও বিভ্রান্তির ছাপ ছিলো স্পষ্ট। যতক্ষণে গোটা বিষয়টি বুঝতে পারেন, ততক্ষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এমন এক পরিস্থিতিতে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে তিনি বক্রোক্তি করে বলেন, পর্যাপ্ততা এবং পর্যাপ্ততার ধারনাটিকে এমনভাবে প্রচার করতে হবে যাতে তা অসুস্থকর পরিস্থিতিতে চলে যায়। ব্রিটিশশাসিত উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বাংলায় চালের দামের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছিলো। কিন্তু তা দূর করার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি সোহরাওয়ার্দী সরকার। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের জুনের শুরুর দিকে বাংলার চাঁদপুরে প্রতি মণ চালের মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ রুপি ৮ আনায়। একই সময়ে বিহারের পূর্ণিয়ায় তা বিক্রি হয়েছে ১৮ রুপি ২ আনায়। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের দাম হওয়ায় বাংলার ব্যবসায়ীদের মুজত প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। আরো প্রকট হয়ে ওঠে সরবরাহ সংকট। কারণ ব্যবসায়ীদের কারসাজি বুঝা বেশ কঠিন।
দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা বৃদ্ধির পেছনে বড় ব্যবসায়ীদের চালের মজুত প্রবণতাকে দায়ী করা হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ করছিলো না আর জনণের ভোগান্তিও কমছিলো না। কম পরিমাণ চাল ব্যবহার করে পাতলা জাউজাতীয় খাবার চালু করা যায় কিনা সেটি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া হয় এবং চালের বিকল্প খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়। এগুলো সবই ব্যর্থ পদক্ষেপের প্রমাণ দেয়। সোহরাওয়ার্দী দাবি করেন ব্রিটিশশাসিত উপমহাদেশের অন্যান্য অংশ বাংলার বিপজ্জনক পরিস্থিতি অনুধবান করতে পারছে। শিগগিরই সেখান থেকে সরবরাহ আসা শুরু হবে, ফলে দামও কমবে কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ছিলা পুরো আলাদা। এ বক্তব্য পত্রিকাকেও বিভ্রান্ত করার মতো অবস্থা হয়েছিলো। কারণ এসব বক্তব্য চালের বাজারে পজিটিভ কোনো প্রভাব তো ফেলেইনি বরং অবস্থা আরো জটিল করে তুলেছিলো।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে সরকারের পক্ষ থেকে চালের সর্বোচ্চ মূল্য বেধে দেয়া হয় প্রতি মণ ৩০ টাকা যা ডিলার বা ব্যবসায়ীদের পক্ষে সেই মূল্যে চাল সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত। শুধু মূল্য নির্ধারণ এক্ষেত্রে কাজ করবেনা যা তারা বুঝতে পারেননি। এতে আড়ত বন্ধ হয়ে গিয়ে কালোবাজারে চালের দাম হয় ৪০ রুপি। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে বাজারে চাল আসতে থাকায় দাম কিছুট কমতে শুরু করে কিন্তু দুর্ভিক্ষের প্রভাব বহাল থাকে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের শেষ পর্যন্ত।
ফলে শেরেবাংলার মতো নাজিমুদ্দিনের সরকারও ব্যাপক হারে জনপ্রিয়তা হারায়। মুসলিম লীগের মধ্যে তৈরি হয় বিভিন্ন দল উপদল। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে প্রাদেশিক অ্যাসম্বলিতে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভা। বাংলাদেশ সেই ১৯৪৩-এর মতো ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দেও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। ফসলের উৎপাদন হলেও দুর্নীতি, সরকারের অদক্ষতা, বাজার অব্যবস্থাপনা, ফড়িয়া আর চোরাকারবারীদের সীমাহীন অর্থলিপ্সার করণে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যায়নি ।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের গবেষণায়ও বাংলাদেশে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে প্রশাসনিক ভুলনীতি ও বাজার অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হয়। তার অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে যে, ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ এর মধ্যে বাংলাদেশে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ফসলের উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। তার মানে হচ্ছে দুর্ভিক্ষ প্রাকৃতিক কারণে হয়নি, বরং বাজার অধিকারের অসমতা থেকে।
বিরাট অঙ্কের জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিলো নিত্যপণ্যসহ খাবারের দাম। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে যে, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে চালের মূল্য মণপ্রতি ছিলো ৭১ টাকা যা ১৯৭৫-এর এসে দাঁড়ায় ৩৩০ টাকায়। এর মূল কারণও বাজার অব্যবস্থাপনা এবং তৎকালীন সরকারের ভুল নীতি। এই অবস্থা যেনো আমাদের দেশে বার বার ফিরে আসছে আর ভুল পদক্ষেপও যেনো পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। সাধারণ মানুষ অমানিশার অন্ধকারে যেনো হাতরাচ্ছে। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিশাল, দেশের সর্বক্ষেত্রেই যে সমস্যা চলছে তার সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। তাই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বর্তমান সরকারকে অনুরোধ করছি কারণ জনগণের বহুল প্রতিক্ষীত সরকারকে এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতেই হবে।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক