ধ*র্ষ*ণ মামলা সাজিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশ, সোর্স ও এক কিশোরী মিলে এক কিশোরকে ধর্ষণ মামলায় ফাঁসিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়ের পর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে চক্রান্ত করে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়। পরে পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিয়ে ‘সমঝোতা’ না করায় ওই কিশোরের নামে ধর্ষণ মামলা দেওয়ায় পুলিশ। এমন সাজানো মামলায় কিশোরকে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশের তিন উপপরিদর্শকের (এসআই) বিরুদ্ধে।   

তারা হলেন-ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) মোহাম্মদপুর থানার এসআই পবিত্র কুমার মন্ডল, চয়ন সাহা ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার রাজিব সাহা। সঙ্গে রয়েছে চয়ন সাহার সোর্স হৃদয় ও কিশোরী ঐশী (ছদ্মনাম)।

গত ২৫ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় ধর্ষণ মামলা করা হয় ওই কিশোরের নামে। এ ঘটনার পর কীভাবে কিশোরকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে এবং এই মামলায় সমঝোতা করতে কত টাকা লাগবে, মামলা হলেও আসামিকে আটক করবে না এবং ধর্ষণের মেডিকেল রিপোর্ট ভুল এনে দিতে কত টাকা দিতে হবে-এমন দরকষাকষির কয়েকটি অডিও রেকর্ড গণমাধ্যমের হাতে এসেছে।

ওইসব অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, মোহাম্মদপুর থানার দুই এসআই রাজিব ও পবিত্র কুমার মন্ডল ভুক্তভোগী ওই কিশোরের মায়ের সঙ্গে দরকষাকষি করছেন। ‘তুমি টাকা দাও আমরা রিপোর্ট পরিবর্তন করে দেব। আর তোমার ছেলেকেও পুলিশ গ্রেফতার করবে না। জিনিস যত কসলাইবা তত ঝামেলা হইব। তুমি বুইঝা দেখো। অনেক কষ্টে আমি আমার সিনিয়রকে (এসআই পবিত্র) ৫০ হাজার টাকা দিতে রাজি করিয়েছি। সে তো ৮০-এর নিচে রাজিই না। সে তো তোমার ছেলেকে গ্রেফতার করবে। চয়ন (এসআই) লাইগা আছে তোমার ছেলেকে ধরার জন্য। র‌্যাব যাইয়া তোমার ছেলেরে ধইরা নিয়ে আসবে। রিপোর্ট আসলে তখন ওই মেয়ের সঙ্গেও বইসা লাভ নাই। তুমি বুঝো না মেয়ে কেমন বাটপার। মেয়ের সঙ্গে বসতে চাইলে মেয়ে যদি ৫ লাখ চায় তখন ওইটাই দিতে হবে। তোমার ছেলের জন্য ভালো হবে বলে দিলাম।’ 

কথোপকথনটি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার উপপরিদর্শক রাজিব সাহা, মোহাম্মদপুর থানার এসআই পবিত্র কুমার মন্ডল ও এসআই চয়ন সাহা এবং তার সোর্স হৃদয় নামে এক মাদক ব্যবসায়ীর।

জানা যায়, ঐশী (ছদ্মনাম) নামের এক কিশোরীর সঙ্গে আকাশ (ছদ্মনাম) নামের এক ছেলের ফেসবুক থেকে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। দুজনেই অপ্রাপ্তবয়স্ক। কিশোরের জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী তার বয়স ১৫ বছর আর কিশোরীর স্কুলে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৭ বছর ৯ মাস। তবে দুজনেই অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেও মামলার নথিতে মেয়ের বয়স ১৮ আর ছেলের বয়স ১৯ দেখিয়েছে থানা পুলিশ।

মামলার বাদী কিশোরী ঐশী বলে, ‘আমাদের সম্পর্কে ফাটল দেখা দিলে আমি বিষয়টি আমার এক বান্ধবীকে বলি। এরপর সে আমার সঙ্গে মোহাম্মদপুর থানার এসআই চয়নের সোর্স হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। হৃদয় আমাকে দিয়ে এসআই চয়নের মাধ্যমে থানায় একটি অভিযোগ দেওয়ায়। ওইদিনই এসআই চয়ন আমাকে নিয়ে ওই ছেলের বাসায় যায়। বাসায় গিয়ে ছেলের মাকে বিষয়টি বলি। তিনি আমার কথা শুনে আমাকে বাসা থেকে চলে যেতে বলেন। পরে আমি অভিযোগ উঠিয়ে নিতে চাইলে পুলিশ সেটা করতে দেয়নি। মেডিকেল টেস্টের নাম করে আমাকে ওইদিন সারা রাত থানায় আটক করে রাখে। আমার বাসায় মা চিন্তা করবে বললেও পুলিশ আমাকে ছাড়েনি। সকালে আমাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে নিয়ে টেস্ট করানোর পরে ছাড়ে। পরে শুনি আমার অভিযোগটি মামলা হয়ে গেছে। পরে আমি আরও জানতে পারি, আমাকে হাতিয়ার বানিয়ে ওই ছেলের মায়ের কাছে টাকা দাবি করেছে পুলিশ।

জানা গেছে, সেই মামলার সূত্র ধরে গত মঙ্গলবার গভীর রাতে এসআই পবিত্র মন্ডলের নেতৃত্বে ওই কিশোরের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় বেডরুমে ঢুকে ছেলের মাকে মারধর করা হয়। ছেলের মায়ের জামা ছিঁড়ে ফেলা হয়। ওই সময়ের একটি অডিও এসেছে গণমাধ্যমের হাতে। অডিওতে শোনা যায়, ওই কিশোরের মায়ের বেডরুমে ঢুকে তার ভিডিও নিচ্ছিল এসআই পবিত্র মন্ডল। ওই নারী তাকে রুম থেকে বের হতে বলেন। তবে তাতে কর্ণপাত না করে বেডরুমের ভিডিও করতে থাকে পুলিশ। এ সময় নিজের মানসম্মানের কথা বলে বারবার ভিডিও করতে না করেন ওই নারী। এরপর ওড়না পরে বাইরে আসছেন জানিয়ে পুলিশকে রুম থেকে বের হতে বলেন তিন। একপর্যায়ে ওই ভিডিওতে ওই নারীর চিৎকার শোনা যায়।

জানতে চাইলে কিশোরের মা আসমা আক্তার বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে এসআই পবিত্র ও কয়েকজন মিলে আমার বাসায় গিয়ে বেডরুমে ঢোকে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা এক আনসার আমাকে লাথি মেরে আমার রুমের দরজা ভেঙে ফেলে। তখন আমি তাকে বলি-আপনি বাইরে যান, আমি ওড়নাটা পরে আসি। সে আমার কথা না শুনে আমার গায়ে হাত দেয়। এরপর তারা আমার ছেলেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে এসআই রাজিব ও এসআই পবিত্র সমঝোতার জন্য ২ লাখ টাকা দাবি করে। এসআই রাজিব আমার সঙ্গে এই বিষয়ে একাধিকবার দেখা করে। আমি টাকা না দেওয়ায় আমার ছেলের নামে মিথ্যা মামলা করায়। মামলার পরেও তারা সমঝোতার জন্য টাকা দাবি করে। টাকা দিলে মেয়ের মেডিকেল রিপোর্ট ঘুরিয়ে দেবে বলেও জানায় সে। না হলে আমার ছেলেকে গ্রেফতার করার হুমকি দেয়। পরে মঙ্গলবার রাতে আমার বাসায় ঢুকে ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোহাম্মদপুর থানার এসআই চয়নের সোর্স হিসেবে পরিচিত হৃদয় প্রথমে বিষয়টি চয়নকে জানায়। পরে মামলা হওয়ার আগেই চয়ন ওই মেয়েকে নিয়ে ওই কিশোরের বাসায় গিয়ে টাকার বিনিময়ে বিষয়টি সমঝোতার কথা বলে কিশোরের মাকে। সে সময় ছেলের মা রাজি না হওয়ায় তারা ফিরে এসে মেয়েকে ফুসলিয়ে অভিযোগ করান। এ ঘটনায় এই চক্রের মূল হোতা মোহাম্মদপুর থানার এসআই চয়ন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চয়নের হয়ে সমঝোতা করেন তার সোর্স মাদক ব্যবসায়ী হৃদয়। আর তদন্তের নামে বাসাবাড়িতে গিয়ে হুমকি-ধমকি দেন এসআই পবিত্র।

জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার এসআই চয়ন বলেন, আসলে এই ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত নই। আর ওইটা আমার এলাকাও না। আর ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই পবিত্র মন্ডল।

আপনার এলাকা না হলে মামলা হওয়ার আগে ওই কিশোরের বাড়িতে আপনি কেন গিয়েছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে চয়ন বলেন, আমি প্রাথমিক তদন্ত করতে গিয়েছিলাম। প্রাথমিক তদন্তের পর বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়েছে আর ওই মামলার তদন্তে দায়িত্ব পেয়েছে এসআই পবিত্র মন্ডল। এরপর ওই বিষয়ে আমি কিছু জানি না। সোর্সের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন।

এ ঘটনায় জড়িত তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার আরেক এসআই রাজিব সাহা বলেন, আসলে ওই কণ্ঠটি আমার নয়। আমি টাকা-পয়সার বিষয়ে কোনো কথা বলিনি। আর আমি এখন মোহাম্মদপুরে নাই, এখন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে। তাহলে মঙ্গলবার আপনি ওই কিশোরের মায়ের সঙ্গে মোহাম্মদপুরের সিটি হাসপাতালের গলিতে দেখা করছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রাজিব সাহা বলেন, ‘ওই মহিলা আমার পূর্বপরিচিত। ওই মহিলা ফোন দিয়ে আমার কাছে হেল্প চাইছিল। বলছে তার ছেলের নামে একটি মামলা হয়েছে। এই বিষয়ে আমি তাকে হেল্প করতে গিয়েছিলাম। তবে টাকা-পয়সার বিষয়ে তার সঙ্গে আমার কোনো কথা হয় নাই।’

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই পবিত্র কুমার বলেন, আমি মঙ্গলবার রাতে ওই আসামিকে তার বাসা থেকে আটক করি। এ সময় তার মা বাধা দেয়। টাকা দাবি করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মোবাইল ফোনের লাইন কেটে দেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভূঞার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম - dainik shiksha ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় - dainik shiksha এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো - dainik shiksha প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036361217498779