‘চাচি পুলিশ। বেটিও সব সময় তাঁর মতো দারোগা হতে চেয়েছিল। আমিও বলতাম, চাকরির আগে বিয়ে দেব না। মোটা হওয়ার ভয়তে বেটি আমার অল্প করে ভাত খেত। ইসরে, ওহরে ... ওরা (শিক্ষকরা) আমার সব শেষ করে দিছেরে, স্বপ্ন ভেঙে দিছে।’– বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন বিদ্যালয়ে ধূমপানের জেরে শিক্ষকদের বকুনির অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া জিনিয়া খাতুনের মা শান্তা খাতুন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামে জিনিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা শান্তার কান্না থামছেই না। ভাঙাড়ি জিনিসপত্রের ব্যবসায়ী বাবা জিল্লুর রহমান নির্বাক। তাদের একমাত্র ছেলে মো. জিহাদ (৫) মৃত্যু কী বুঝতে না শিখলেও বোনকে বারবার এনে দিতে বলছে। গত সোমবার কুমারখালীর কয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর মাহ্তাবিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাদে উঠে পাঁচ ছাত্রী ধূমপান করে। বিষয়টি জানতে পেরে শিক্ষকরা তাদের ভিডিও ধারণ ও শাসন করে এগুলো অভিভাবকদের মধ্যে ছড়ানোর হুমকি দেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে দুই ছাত্রী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। স্থানীয়রা তাদের জীবিত উদ্ধারে সক্ষম হলেও বিকেলে বাড়ি ফিরে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী (১৪) জিনিয়া খাতুন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় বুধবার রাতে কুমারখালী থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে মামলা করেন নিহতের মা শান্তা খাতুন। এতে আসামি করা হয়েছে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মশিউর রহমান লাল্টু (৪৫), ওলিউর রহমান অলিদ (৫০), মাহবুবা খাতুন (৪০) ও আয়া শিউলি খাতুনকে (৪২)। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শান্তা খাতুন বলেন, ‘আমার মেয়ে কোনো দিন সিগারেট টানেনি। শিক্ষকরা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দুই ঘণ্টা শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করেন। অপমান সইতে না পেরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আমি ন্যায়বিচার চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের খোঁজ নেয়নি। উল্টো প্রধান শিক্ষক মরদেহ দেখতে এসে বিদ্রুপ করেন এবং শাসন করে শিক্ষকরা অন্যায় করেননি বললে বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁকে মারধর করে।’
বাবা জিল্লুর রহমান দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা ভুল করতেই পারে। শিক্ষকদের উচিত ছিল বিষয়টি অভিভাবকদের জানানো।’ জিনিয়ার প্রতিবেশী দাদি কাজলী খাতুন ও খালা মেরিনা খাতুন জানান, এ যুগে জিনিয়ার মতো ভদ্র স্বভাবের মেয়ে পাওয়া কঠিন। তার বিরুদ্ধে বিড়ি টানা, প্রেম করা বা অন্য কোনো অভিযোগ কখনও তারা শোনেননি। শিক্ষকদের মিথ্যা অপবাদই তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে। সহপাঠী সামিয়া খাতুন ও ফাতেমা খাতুন জানায়, ঘটনার দিন দুপুর ২টার দিকে বিদ্যালয় ছুটি হয়। কিন্তু বিকেল ৪টা পর্যন্ত জিনিয়াদের কক্ষে আটকে রাখেন শিক্ষকরা। কক্ষের বাইরে থেকে তারা শুনতে পান– শিক্ষকরা বারবার জিনিয়াকে বলছিলেন, তোর বিড়ি খাওয়া ছবির নিচে নাম লিখে ফেসবুকে দেব, অভিভাবকদের দেখাব এবং টিসি দিয়ে দেব। জিনিয়া শিক্ষকদের পা ধরলেও, হেনস্তা থামেনি। গতকাল বিকেল ৩টার দিকে বিদ্যালয়ে গিয়ে থমথমে পরিবেশ দেখা যায়। শিক্ষার্থী নেই, জাতীয় পতাকার পাশাপাশি উড়ছে শোকের মাস আগস্ট উপলক্ষে কালো পতাকা। বিদ্যালয়ের নতুন তিনতলা ভবনের ছাদের সিঁড়িঘরে ও ওয়াশব্লকের ছাদে সিগারেটের কয়েকটি অংশবিশেষ এবং একটি গ্যাসলাইট এখনও পড়ে আছে। এ সময় বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক এস এম আশরাফুল হেলাল বলেন, ‘তিনতলা ও সিঁড়িঘরে শুধু ছাত্রীরা থাকে, ছাত্রদের আসা নিষেধ। সোমবার এখানেই মেয়েগুলো সিগারেট টানছিল এবং সেদিনই প্রথম সবার নজরে আসে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জিনিয়ার আচার-ব্যবহার ভালো ছিল। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকরা শুধু মেয়েদের শাসন করেন।
নির্যাতন কিংবা ভিডিও করা হয়নি। বিকেল ৪টা পর্যন্তই বিদ্যালয় খোলা ছিল।’ জানা গেছে, গতকাল ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৪০০ জন উপস্থিত হয়। তারা নিহত ছাত্রীর দোয়া অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। এর পর বিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি ঘোষণা করা হয়। ভারপ্রাপ্ত ইউএনও আমিরুল আরাফাত জানান, জেলা প্রশাসন ও বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ পৃথক তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্তে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। ঘটনার পর থেকে আসামিরা আত্মগোপনে। তাদের ধরতে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন কুমারখালী থানার ওসি আকিবুল ইসলাম। সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি বিদ্যালয়ে ছিলাম না। পরের দিন মেয়েটির জানাজায় গেলে হামলার শিকার হই। এ ঘটনায় মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ।’ এদিকে বুধবার বিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সভা করে জেলা বেসরকারি শিক্ষক সমিতি প্রধান শিক্ষকের ওপর হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনতে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়। জেলা বেসরকারি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান জানান, জেলা পর্যায়ে আন্দোলন করার জন্য বৃহস্পতিবারের মানববন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জিয়াউল ইসলাম স্বপন জানান, ছাত্রীর আত্মহত্যা এবং প্রধান শিক্ষককে মারধরে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।