নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকাই উত্তম

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষাক্রম যে কোনো শিক্ষাব্যবস্থাকে পথ দেখায়। সঠিক পথই শিক্ষার রূপ দিতে পারে। একটি জাতি তখনই আলোর মুখ দেখে, যখন সঠিক শিক্ষানীতি দৃঢ় পায়ে দাঁড়ায়। 

গত বছরে পাইলটিংয়ের তথ্য-উপাত্ত কি সবার সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছিল? উত্তর—না। যদি সবার সঙ্গে শেয়ার করা যেত, তাহলে একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যেত। নতুন কারিকুলামের পঠন প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়ে বছরের শুরু থেকেই একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়। শিক্ষকেরা বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা রপ্ত করবে নতুন শিক্ষাক্রমের প্রতিটি শিক্ষন অভিজ্ঞতা। বুধবার (৫ জুলাই) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ইতিমধ্যে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন সমাপ্ত হয়েছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নির্দেশনা ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের কয়েক দিন আগে হাতে আসে।

তাই যথার্থ সময় না পেয়ে শিক্ষার্থীরা মূল্যায়নে কিছুটা হ-য-ব-র-ল হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ শিক্ষক এখনো পরিষ্কার নন নতুন শিক্ষাক্রম প্রসঙ্গে। শ্রেণি কার্যক্রমে তারা এখনো গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় আগাচ্ছেন। অধিকাংশ শিক্ষার্থী জানেই না তারা চূড়ান্ত মূল্যায়নের দিনে কী প্রেজেন্ট করবে। এতে অভিভাবকবৃন্দ নেতিবাচক বিচার-বিশ্লেষণ করা শুরু করে দিয়েছেন, যা নতুন কারিকুলামের প্রধান অন্তরায় বলে বিবেচিত হচ্ছে। 

শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলামে ব্যাবহারিক উপকরণে খরচের চাপে পড়ছে, যা দরিদ্র পরিবারের পক্ষে কষ্টসাধ্য। কিন্তু শিক্ষক নির্দেশনায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, কোনো উপকরণের জন্য যেন শিক্ষার্থীরা আর্থিক চাপে না পড়ে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে উপকরণের খরচ শিক্ষার্থীর ঘাড়ে ফেলছে।    

অভিভাবকেরা এখনো বুঝতে পারছে না তাদের সন্তানেরা বিদ্যালয়ে কী পাঠ রপ্ত করছে। বলা চলে, অধিকাংশ অভিভাবক একটা ত্রুটিপূর্ণ ধারণা নিয়ে আছেন। আমরা শিক্ষকেরাই তাঁদের নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি করছি। একটা উদাহরণের মাধ্যমে পরিষ্কার করা যাক, শিক্ষকদের একটা গোষ্ঠী, যারা প্রাইভেটের সঙ্গে যুক্ত, তারা অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলার সময় নতুন কারিকুলামের ইতিবাচক বিষয়গুলো না তুলে ধরে নেতিবাচক বিষয় উপস্থাপন করছেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, প্রাইভেট থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তারা গতানুগতিক শিক্ষাকেই বেশি ভালো বলে প্রচার চালাচ্ছেন।

বিদ্যালয়ের পরিবেশগত সমস্যাও নতুন কারিকুলামের অন্তরায়। শুধু তাই নয়, যোগ্য শিক্ষক না থাকায় এই কারিকুলাম আলোর মুখ দেখতে পারছে না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ঠিক দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু বিদ্যালয়ে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। তারা নতুন কারিকুলামের প্রশিক্ষণের জন্য যতটা অস্থির ও আগ্রহী, ক্লাস বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ততটাই উদাসীন।

অধিকাংশ বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে, যা কার্য পরিচালনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। তাছাড়া একই দিনে অনেকগুলো বিষয়ের অনুসন্ধানী ও তথ্য যাচাই-বিশ্লেষণে কাজগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। গ্রামাঞ্চলে অনেক শিক্ষার্থী প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহারও করতে পারছে না। শহুরে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি থাকায় ভালোভাবে পাঠদান হচ্ছে না।

নতুন শিক্ষাক্রমে সবচেয়ে বড় বাধার কারণ হচ্ছে অধিকাংশ শিক্ষক টিজি, অর্থাৎ শিক্ষক সহায়ক নির্দেশিকা অনুসরণ না করেই মনগড়া পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে শিক্ষাক্রমের বাস্তব রস থেকে শিক্ষার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে ক্লাসের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনীহা দেখা যাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-শেখানো কার্যক্রম বিদ্যালয়ের বাইরেও পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে অনুশীলন করা এবং সব শিক্ষার্থীর অভিন্ন মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্য শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বিশেষায়িত বিষয়গুলোর যৌক্তিক সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করতে হবে।

অনেক বিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে, এনসিটিবি মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ না করে গতানুগতিক পরীক্ষার মাধ্যমে ষাণ্মাসিক পর্ব শেষ করেছে। ফলে শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়ন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সামগ্রিক মূল্যায়ন ব্যবস্থাই ত্রুটির মধ্যে থেকে যাচ্ছে।  

নতুন শিক্ষাক্রমের আর একটি বিশেষ বাধা হচ্ছে, বইয়ের ভাষা কিছুটা জটিল। শিক্ষার্থীদের বয়সভেদে বইয়ের ভাষা তেমন সহজ ও সাবলীল হয়নি। বইয়ের ভাষা সহজ, সরল ও সাবলীল হলে শিক্ষার্থীরা আগ্রহের সঙ্গে পড়তে উত্সাহিত হবে। তাছাড়া বইয়ে অনুশীলন চর্চার সুযোগ রাখতে হবে। শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি অনুশীলনীর কাজগুলো যথার্থ করালে বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে। শুধু দলগত কাজে চাপ দিলেই হবে না, একক কাজও তাদের জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে। ক্লাসের পিরিয়ড কমিয়ে সময় বাড়ালে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষণ পূর্ণতা পাবে।

অভিভাবকদের দৃষ্টি ইতিবাচক করার লক্ষ্যে শিক্ষকদেরই ভূমিকা নিতে হবে। সামাজিক গণমাধ্যমে নতুন কারিকুলামের কার্যক্রম বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। প্রয়োজনে অভিভাবকদের ক্লাস চলাকালীন বিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানাতে হবে এবং তাদের সন্তানেরা কী শিখছে তা অনুধাবনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষক অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন, যেন তারা শিখন কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত হন। 

নতুন কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মানভিত্তিক একটি রূপরেখা। তাই এটি বাস্তবায়নে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকাই উত্তম। কারণ যৌক্তিক গবেষণা ফেল নিয়েই এটি সাজানো হয়েছে। একটু তো সময় লাগবেই প্রতিটি স্তরে খাপ খাওয়াতে। তাই ধৈর্য ধরে আগাতে হবে, একটি গতানুগতিক পরিবেশকে পেছনে ফেলতে সময় লাগবে। কিন্তু যে ঘাটতিগুলো চোখে পড়ছে, সেগুলো শুধরে নিতে হবে। 


লেখক : মো. আরফাতুর রহমান (শাওন), শিক্ষক, বংশাল, ঢাকা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ - dainik shiksha শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! - dainik shiksha দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি - dainik shiksha ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031380653381348