নতুন শিক্ষাক্রমকে স্বাগত জানাই। আমরা নতুন কিছুতে গেলে মনে করি, পুরনো কোনোকিছুই আর রাখছি না। সব নতুন করে সাজাচ্ছি। এটা বড় ভয়াবহ দৃষ্টিকোন। বিদেশি একটা পোশাক এনে পরবো আর মনে করবো, সেটা আমার জন্য ফিট হয়ে যাবে- এমনটা আশা করা অত্যন্ত অপরিপক্ক চেতনা।
আমরা যে আধুনিক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম করেছি, নতুন টেক্সটবুক করেছি। ধারাবাহিক মূল্যায়নের প্রস্তাব করেছি, শ্রেণিকক্ষে চর্চা করার প্রস্তাব করেছি, সবগুলোই আমি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাই। আমাদের সৃজনশীল পদ্ধতির কোনোরকম দুর্বলতা আমি দেখি না, একাডেমিক দিক থেকে।
বড় প্রশ্ন হল, আমার প্রেক্ষিত কতোটা প্রস্তুত। আমার কনটেক্সটে কি সেটা যায়? একটা প্রশ্ন দিয়ে যদি বলি, নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের জন্য যে ল্যাবরেটরি থাকার কথা সেটা কতোগুলো বিদ্যালয়ে আছে? এই যে শিক্ষা বোর্ড থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস নেওয়ার প্রস্তাবনা করা হয়েছে, সেখানে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ধারাবাহিক ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব টিচার মাস্ট। একজন শিক্ষক প্রথম মাসে কী করবেন সেটা মাসের প্রথম দিন বুঝিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় মাসে কি করবেন তা প্রথম সপ্তাহে বুঝিয়ে দিতে হবে।
তাড়াহুড়োর বিষয়ে আমি দুটো দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনার কথা বলবো। চরম দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘদিন লার্নিং গ্যাপ নিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চলছে। সেই লার্নিং গ্যাপ পূরণেও আমরা সেরকম অশাব্যাঞ্জক উদ্যোগ দেখিনি। তার মধ্যে হঠাৎ করে আমূল পরিবর্তনের যে চর্চা আমরা প্রস্তাব করছি, সেটি বাস্তবায়ন করার জন্য আমার শিক্ষক কতোটা প্রস্তুত, বিদ্যালয় কতোটা প্রস্তুত?
অজ্ঞিতা ভিত্তিক যে শিখন চর্চার কথা বলা হয়েছে তার জন্য প্রয়োজন বিদ্যালয়ের প্রস্তুতি। শুধু শিক্ষক প্রশিক্ষণ দিয়ে যদি এটি হয়ে যেত, তাহলে দুঃখ ছিলো না। এখানে শিক্ষকের যেমন প্রস্ততি প্রয়োজন, শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি প্রয়োজন, অভিভাবকেরও প্রস্তুতি প্রয়োজন। যেহেতু বিদ্যালয়ের প্রস্তুতি নেই, শিক্ষকের প্রস্তুতির সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সমাজের প্রস্তুতির সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেক্ষেত্রে আরও একটু সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে এগুনো যেতো।
আমরা একের পর এক পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে গিনিপিগে পরিণত করেছি। আমরা ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে যে চর্চা করবো, এতে যে পরিমাণ অনুশীলন আছে, এর আগেও অনুশীলন ছিলো, তার আগেও ছিলো ‘এসো নিজে করি’। সেই এসো নিজে করি আর এই শিক্ষার্থীরা পড়ে পড়ে শিখবে- এ দুই এর মধ্যে খুব বেশি অভিনব আবিষ্কার দেখছি না। আমি দেখছি, ওই বিষয়গুলো আমাদের মধ্যে আছে। কিন্তু সেটার জন্য আমার মাঠ কতোটুকো প্রস্তুত সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। শুধু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েই যে সেটা শ্রেণিকক্ষে চর্চা করা সম্ভব হবে সেটা মনে করি না।
সপ্তম শ্রেণিতে যে বিজ্ঞানের জন্য চর্চার কথা বলা হয়েছে- আমাদের ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণির জন্য কতোটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার আছে?
ধারাবাহিক মূল্যায়নের কথা আমরা যে বলছি, তিনটা ক্যাটাগরিতে ভাগ করছি। কোনো অসুবিধা নেই, যে কোনো একটায় আপনি স্কোর দিতেও পারেন, নাও পারেন। কিন্তু লার্নিংটা নিশ্চিত করবে কে?
তাই আমি মনে করি, সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে সবাইকে একই স্কেলে না দেখে, ক্লাস্টারওয়াইজ ভাগ করা অত্যন্ত জরুরি ছিলো। প্রত্যেক বিদ্যালয়ের লেভেল, স্তর ও তদের গুণগত পর্যায়, শিক্ষক সংখ্যা, শিক্ষার্থী সংখ্যা একই না। জোনওয়াইজ, ক্লাসওয়াইজ এই পরীক্ষণ কাজটি করে সারাদেশে এটি করলে আরো বেশি সুফল পাওয়া যেতো। এখনও সে সময় আছে।