নতুন শিক্ষাক্রম : এদেশ থেকে আর বড় বিজ্ঞানী-ডাক্তার পাব না

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

নতুন শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি হাতে পেলাম। এ শ্রেণিতে উঠে শিক্ষার্থীরা মাত্র ৫৮ পৃষ্ঠার তিনটি চ্যাপ্টার পদার্থবিজ্ঞান পড়বে। প্রথম চ্যাপ্টারে নিউটনের সূত্র, দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে তাপমাত্রা ও তাপ আর তৃতীয় চ্যাপ্টারে পড়বে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান, যেখানে আছে তরঙ্গ-পার্টিকেল ডুয়ালিটি, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার প্রিন্সিপাল ইত্যাদি। এ বইয়ের বাকি চ্যাপ্টারে আছে রসায়ন ও জীববিজ্ঞান। শনিবার (২ ডিসেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, একই দেশের ইংরেজি মাধ্যমের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ২১৬ পাতার আটটি চ্যাপ্টারের পদার্থবিজ্ঞানের বই পড়ে; যেখানে থাকে ইউনিটস ও মেজারমেন্ট, ইলেকট্রিসিটি,

ফোর্সেস অ্যান্ড মোশন, রশ্মি ও তরঙ্গ, আর্থ অ্যান্ড স্পেস, এনার্জি, ম্যাগনেটস অ্যান্ড কারেন্ট, এটমস অ্যান্ড নিউক্লেই ইত্যাদি। অর্থাৎ ইংরেজি মাধ্যমের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যা পড়বে বা জানবে, নতুন কারিকুলামে বাংলা মাধ্যমের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তা পড়বে বা জানবে না।

আর নবম-দশম শ্রেণি পর্যায়ের ‘ও লেভেলে’ আছে ২৭১ পাতার পূর্ণাঙ্গ পদার্থবিজ্ঞান বই, যেখানে রয়েছে আটটি ইউনিট। ফোর্স অ্যান্ড মোশন, ইলেকট্রিসিটি, ওয়েভস, এনার্জি রিসোর্সেস, সলিড্স, লিকুইডস অ্যান্ড গ্যাসেস, ম্যাগনেটিজম অ্যান্ড ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম, রেডিওঅ্যাক্টিভিটি অ্যান্ড পার্টিকেল এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্স।

তাহলে একই দেশের নবম-দশম শ্রেণি পাশ করা ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের পার্থক্য বুঝতে পারছেন? ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা সপ্তম শ্রেণিতে যতটা পদার্থবিজ্ঞান পড়বে, বাংলা মাধ্যমের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও ততটা গভীরে পড়বে না। এ বৈষম্য কীভাবে ঘুচবে? কোনোদিন ঘুচবে না। আবার নতুন শিক্ষাক্রমে উচ্চতর গণিত নবম-দশম শ্রেণি থেকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগে মানবিক বিভাগ নিয়ে যারা পড়ত, তাদেরও কেউ কেউ চতুর্থ বিষয় হিসাবে উচ্চতর গণিত নিত, যাতে ভালো নম্বর পাওয়া যায়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। অর্থনীতিতে ক্যালকুলাসের ব্যবহার অনস্বীকার্য। অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে মেজর এবং গণিতে মাইনর ছিলেন। গণিতে শক্ত ভিত্তির কারণেই তিনি অর্থনীতিতে এত ভালো।

অথচ ইংরেজি মাধ্যমের নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গণিতে ৪৪৩ পাতার একটি পূর্ণাঙ্গ বই পড়ে। এ বইয়ে আছে ১২টি চ্যাপ্টার-যেখানে আছে নাম্বার, এলজেব্রা-১, পরিমিত বিদ্যা, জিওমেট্রি, এলজেব্রা-২, ট্রিগোনোমেট্রি, গ্রাফস, সেট্স, ভেক্টরস অ্যান্ড ফাংশনস, ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ট্রান্সফর্মাশন্স, স্ট্যাটিসটিক্স অ্যান্ড প্রবাবিলিটি, ইনভেস্টিগেশনস, প্র্যাকটিক্যাল প্রবলেমস অ্যান্ড ধাঁধা। অর্থাৎ বর্তমান কারিকুলামের উচ্চতর গণিতের অনেক কিছুই ইংরেজি মাধ্যমের নবম-দশম শ্রেণির গণিতের বইয়ে আছে। ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানী কিংবা অর্থনীতিবিদ হওয়ার জন্য উচ্চতর গণিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর একেই কিনা একেবারে উধাও করে দেওয়া হয়েছে।

আমার আশঙ্কা, নতুন শিক্ষাক্রম যারা পড়ে আসবে, তাদের মধ্য থেকে এমন মেধাবী আর হয়তো পাব না। এদেশ থেকে আর বড় বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার পাব না আমরা।

নতুন শিক্ষাক্রমে যেহেতু বিভাগ উঠিয়ে দিয়ে সবার জন্য ১০টি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাই বর্তমান শিক্ষাক্রমের এসব চ্যালেঞ্জিং ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সামান্যই রাখা হয়েছে। তারা গণিত কত কম জানবে! একই কথা বলা চলে রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। গণিত হলো পদার্থবিজ্ঞানের ভাষা। গণিত কম জানা মানে পদার্থবিজ্ঞান কম জানা এবং কম বোঝা। শুধু ইংরেজি মাধ্যমেই এসব চ্যালেঞ্জিং বিষয় আছে এমন নয়।

চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানিতে যারা বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়ে, তারা আরও গভীর পর্যায়ের পদার্থবিজ্ঞান পড়ে। ম্যাক্স প্ল্যাংক মাত্র ১০ বছর বয়সে শক্তির নিত্যতা সূত্র স্কুলে পড়েছিলেন। সেই জায়গায় আমাদের শিশুরা কী পড়ছে?

প্রশ্ন হলো, নবম বা দশম শ্রেণির নতুন পাঠ্যক্রমের ভেতরে যতটুকু বিজ্ঞান আর গণিত রয়েছে, তা কি একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞানের আলাদা আলাদা বইগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে? একদমই না।

নতুন শিক্ষাক্রমে একটা মাত্র বিজ্ঞানের বই পড়ে একাদশের শিক্ষার্থীরা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন আর জীববিজ্ঞান-আলাদা তিনটি বিশাল সিলেবাসের ভার বইতে পারবে না। এই সামান্য বিষয়টা বুঝতে বিজ্ঞানী হওয়া লাগে না। তার মানে এখন উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসও কেটেছেঁটে লঘু করতে হবে! তাহলে নতুন শিক্ষাক্রম পড়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা কীভাবে গণিত অলিম্পিয়াড করবে? কীভাবে ফিজিক্স অলিম্পিয়াড করবে? অথচ বর্তমান শিক্ষাক্রম পড়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা এ দুটিসহ অন্য সব অলিম্পিয়াডে খুবই ভালো করছে।

আমার বড় কন্যা যখন বিদেশে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন বাংলাদেশের বাংলা মাধ্যমের সেরা কয়েকটি কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সে তাদের পারফরম্যান্স দেখে আমাকে বলেছিল, বাংলা মাধ্যমের ছেলেরা তো সাংঘাতিক মেধাবী।

প্রতিবছর বাংলা মাধ্যমের বহু শিক্ষার্থী বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাচ্ছে। তারা আরও ভালো করত, যদি স্কুলগুলোয় ভালোমানের শিক্ষক থাকত, আমাদের স্কুলের শিক্ষকরা যদি শ্রেণিকক্ষে আরও অধিক মনোযোগী হতেন। হবেন কীভাবে? অতি অল্প বেতনে তারা তো জীবন চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন।

অনেকেই বাংলা মাধ্যমের বর্তমান সিলেবাসের ওপর একটা কালিমা লেপে দিয়ে নতুন কারিকুলামের গুণগান গাইতে চাইছে। একটা কথা চালু আছে যে, বাংলা মাধ্যমের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটা মুখস্থ ও কোচিং নির্ভর। না বুঝলে তো মুখস্থ করতেই হবে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান কিংবা গণিতে তো মুখস্থের তেমন কিছু নেই। অথচ মুখস্থের কালিমা লেপে এগুলোই কেটেছেঁটে দেওয়া হয়েছে।

কম্পিউটারের মতো মানুষের মস্তিষ্কে মেমোরি বলে একটা জিনিস আছে এবং তা মনে রাখার জন্যই আছে। কিছু বিষয় মুখস্থ রাখার দরকার আছে। সমস্যা হলো, শ্রেণিকক্ষে বিজ্ঞানকে সার্জারি করে স্লাইস করে করে যৌক্তিকভাবে পড়াতে পারার মতো যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না। কিছু কোচিং সেন্টারে ভালো শিক্ষক আছেন বলেই শিক্ষার্থীরা কোচিংমুখী হয়েছে। কিন্তু যত ভালো শিক্ষকই থাকুক, কোচিং একটা ব্যবসা। সেখানে সঠিকভাবে পড়ানোর বদলে ওই মেধাবী শিক্ষকরা কৌশল বা শর্টকাট রাস্তা শেখান। অথচ কোচিংয়ের মানের শিক্ষকদের যদি বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তাদের যথেষ্ট বেতন দেওয়া হয় আর তারা যদি বিদ্যালয়ে যথেষ্ট সময় দেন, তাহলে বর্তমান বাংলা মাধ্যমের সিলেবাস দিয়ে জাদুকরী সাফল্য সম্ভব।

২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা অনার্স সম্পন্ন করেছিল, তাদের অনেকেই অত্যন্ত মেধাবী। তাদের একজন জার্মানি চলে গেছে, কয়েকজন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে গেছে, বাকিরা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগেই আছে। তত্ত¡ীয় পদার্থবিজ্ঞানে আমি একটি কোর্স পড়াই বলে ওদের সবাইকেই আমি পড়িয়েছি। পড়িয়ে আমি মুগ্ধ। তাদের অন্তত একজন ভর্তি পরীক্ষায় একদম প্রথম দিকে থেকেও পদার্থবিজ্ঞানেই ভর্তি হয়েছে। সে বুয়েটেও সুযোগ পেয়েছিল। সম্প্রতি তাদের কয়েকজন পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে জিআরই দিয়েছিল। তাদের অন্তত দুজনের কথা জানি, যারা ৯৩০-এর উপরে পেয়েছে। একজন সাধারণ জিআরইতে ৩২৩ পেয়েছে, আইইএলটিএসে ৮.৫ পেয়েছে। এছাড়া আমার আরও তিনজন ছাত্র খুবই অল্প প্রস্তুতিতে আইইএলটিএসে ৮ পেয়েছে। তারা সবাই বাংলা মাধ্যমে পড়ে এসেছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমি তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে আনন্দ পাই। আমার আশঙ্কা, নতুন শিক্ষাক্রম যারা পড়ে আসবে, তাদের মধ্য থেকে এমন মেধাবী আর হয়তো পাব না। আমার এ আশঙ্কার কারণগুলো নিশ্চয়ই পুরো লেখা পড়ে বুঝতে পারছেন। বর্তমান বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাক্রমকে আরেকটু কেটেছেঁটে, স্কুলগুলোয় ভালো শিক্ষক দিয়েই আমরা অভ‚তপূর্ব সাফল্য পেতে পারতাম। আসলে বিজ্ঞানের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এদেশ থেকে আর বড় বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার পাব না।

সপ্তম শ্রেণি থেকে আস্তে আস্তে সিরিয়াস বিষয় পড়াতে হবে। নবম শ্রেণিতে এসে যাদের গণিত ও বিজ্ঞানের বিষয় ভালো লাগবে, তাদের গণিত ও বিজ্ঞান নিতে দিন। যাদের মানবিকের বিষয় ভালো লাগবে, তাদের মানবিকের বিষয় নিতে দিন। আর যাদের ব্যবসার বিষয় ভালো লাগবে, তাদের ওইসব বিষয় নিতে দিন। এ সময়টাই ভিত্তি গড়ার সময়।

বহুতল ভবন বানাতে হলে ভিত্তির জন্য মাটির অতি গভীরে যেতে হয়; অর্থাৎ যত উঁচু ভবন হবে তত গভীরে ভিত্তি গড়তে হবে। তাই সপ্তম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এ ভিত্তি তৈরির কাজ স্কুল ও কলেজকে করতে হবে। এখানে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক: ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003917932510376