নতুন শিক্ষাক্রম: গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষার দিকে এগুতে হবে

মাজহার মান্নান |

শিক্ষা হল তাই যা একজন মানুষকে তার নিজের অস্তিত্বের জন্য এবং সমাজের কল্যাণের জন্য দক্ষ করে তোলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, আমাদের বর্তমান মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা যুবকদের মাঝে সেই দক্ষতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ। এমন পরিপ্রেক্ষিতে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। নতুন শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে চলছে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ। একটি গুণগত এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে নতুন এই শিক্ষাক্রমে।

এটি আমাদের কাছে আশা জাগানিয়া খবর। শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন।  শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান  উন্নয়নে যে আভাস পাওয়া গেছে তা থেকে কয়েকটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার।

১. পাঠ্য পুস্তকে  বড় ধরনের পরিবর্তনের, ২. গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, ৩. দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ,  ৪. শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা,   ৫. মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বিভাজন তুলে দেওয়া,  ৬. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তার,  ৭. জীবন ও কর্মমূখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া,  ৮. নৈতিক শিক্ষাকে আরও গুরুত্ব দেওয়া,  ৯. প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির সংষ্কার করা 
এবং  ১০. মানসম্মত কারিকুলাম নিশ্চিত করা।

শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে দ্রুত গতিতে কাজ করে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হলে কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন-  বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে বাজেট শিক্ষা খাতে দেয়া হয় তা মোট বাজেটের ১৫ শতাংশের নিচে। ইউনেসকো বারবার শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ দেয়ার কথা বলে আসছে। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ না বাড়ালে গুণগত শিক্ষার জিকির তুলে কোনো লাভ হবে না।  ব্যানবেইস-এর তথ্য মতে মাধ্যমিক স্তরে ৩০ শতাংশ শিক্ষকের প্রশিক্ষণ নেই। ৩০ শতাংশ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার নেই। অবকাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে না উঠতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।

গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে গাইড ও নোট বইয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের নির্ভরতা কমাতে হবে। মানসম্মত পাঠ্যবই তৈরি ও শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।  অতিরিক্ত কোচিং প্রবণতা কমাতে হবে। গাইড বই ও কোচিং নির্ভরতা শিক্ষার্থীদের সুপ্ত মেধাকে বিকশিত হতে বাধা দেয়। তাই এ দুটোর লাগাম টেনে না ধরতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।

পাঠ্যবইতে প্রশ্ন ব্যাংক তৈরি করে দিতে হবে। নির্ধারিত প্রশ্ন ব্যাংক থেকে সৃষ্টিশীল প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষা পদ্ধতি গুণগত শিক্ষার জন্য মোটেও অনুকুল নয়। অতিরিক্ত পরীক্ষার চাপ, পরীক্ষায় জিপিএ ৫ লাভের একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা গুণগত শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুখস্থনির্ভর ও সনদনির্ভর শিক্ষার জালে আমরা এখনো আটকা পড়ে আছি। শিক্ষা জীবন শেষে শুধু একটি কাগজই হাতে আসে মাত্র। কোনো ধরনের দক্ষতা তৈরি হয় না।  যার ফলে বেকারদের লম্বা সারি তৈরি হচ্ছে।

দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য। কেননা একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে যে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করে অংকে দুর্বলতা নিয়ে। তাই যোগ্য শিক্ষক দরকার হবে। এজন্য শিক্ষকদের ভাল বেতন ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

জীবন ও কর্মমুখী  শিক্ষা ছাড়া আমাদের এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই। এজন্য কারিগরি, ভোকেশনাল ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে।  শিক্ষকদের উচ্চ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্যও বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

উচ্চ শিক্ষার লাগাম টেনে ধরতে হবে। সবার জন্য উচ্চ শিক্ষা প্রয়োজন নেই। উচ্চ শিক্ষা হবে সম্পূর্ণ গবেষণাধর্মী। শিক্ষা নীতিমালা ২০১০-এ যেসব নির্দেশনা আছে, সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে আর কোনো বাধা থাকবে না। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি মানসম্পন্ন হয় তাহলে সেই দেশের উন্নয়ন দ্রুত হয়। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপাল গুণগত শিক্ষার দিকে হাঁটছে। দক্ষ যুবসমাজ তৈরি করতে পারলে আমরা সহজেই উন্নত দেশের কাতারে যুক্ত হতে পারব।

শিক্ষায় বৈষম্য কমানোর জন্য একীভূত শিক্ষার ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন, পদোন্নতিসহ নানা ধরনের বৈষম্য রয়েছে। এসব বৈষম্য নিরসন প্রয়োজন। আর বৈষম্য নিরসনে শিক্ষাবিদরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণের কথা বলেছেন। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে নানা ধরনের জটিলতা ছিল। এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বিভিন্ন সময়ে জটিলতার মুখোমুখি হয়। এর ফলে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের এই অচলায়তন দূর করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু তেমন অগ্রগতি এখনো দৃশ্যমান নয়। দেশে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। এমন অনেক বিদ্যালয় আছে যেখানে প্রতি ক্লাসে শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে একটি ক্লাসে বসিয়ে কোনো শিক্ষকের পক্ষেই গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষকের কথা বলে থাকেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ভারসাম্যপূর্ণ না হলে গুণগত শিক্ষার ধারণাটি কল্পনামাত্র।

শিক্ষাকে কেউ কেউ ব্যবসা হিসেবে নিয়ে থাকেন। আর এ ধরনের মানসিকতা গুণগত শিক্ষার বড় অন্তরায়। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য থাকে, পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের শতভাগ পাস নিশ্চিত করা। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রাখতে এটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শুধু শতভাগ পাসের পিছনে দৌড়ালে চলবে না। শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় পাস করা আর মানসম্মত শিক্ষার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। পরীক্ষায় পাস করে একজন শিক্ষার্থী হয়তো একটি সনদ লাভ করে, কিন্তু সে নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না। সনদনির্ভর শিক্ষা হওয়ার কারণে আজ দেশে এত বেকার সমস্যা। সবাই শুধু সনদের জন্য মরিয়া। প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে থাকার কারণে তারা নিজেদের তৈরি করতে পারে না।

নতুন শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিষয়টি আশাব্যঞ্জক। এর ফলে শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত পরীক্ষার চাপ কমবে এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। পরীক্ষা ভীতি থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে আসতে পারবে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখা খুবই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তও যৌক্তিক। পূর্বে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যের বিভাজন ছিল। সেটা তুলে দেয়া হবে নতুন শিক্ষাক্রমে। এটাও উত্তম সিদ্ধান্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাই একই ধরনের শিক্ষা পাবে যার ফলে তাদের একটি সৃজনশীল মূলভিত্তি তৈরি হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে কোচিং ও গাইড ব্যবসা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষা খাতে অপরাজনীতি ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। একটি সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও সমন্বিত উদ্যোগই পারে গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে। শিক্ষার নানামুখী সংস্কারের পাশাপাশি সরকারকে শিক্ষা জাতীয়করণের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে সর্বপ্রথম মনোযোগ ও গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষার প্রতি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বি এ এফ শাহীন কলেজ কুর্মিটোলা, ঢাকা সেনানিবাস


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030999183654785