নতুন শিক্ষাক্রম : মূল্যায়ন না করে নেওয়া হচ্ছে পরীক্ষা, অধিদপ্তরের অসন্তোষ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার শুরুতেই গলদ দেখছে শিক্ষা প্রশাসন। প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকরা প্রচলিত ধারায় শিখন কার্যক্রম চালাচ্ছেন। অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি সময়ে এসে বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে ষান্মাসিক বা অর্ধবাষিক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। তারা নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীর ‘শিখন শেখানো’ কার্যক্রমের মূল্যায়ন করছেন না। এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। বুধবার (২১ জুন) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, আবার সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাধ্যমিক স্তরের ৩০ হাজারের মতো শিক্ষক নানা অজুহাতে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি। মাউশি এখন ওইসব শিক্ষককে খুঁজছে। মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে প্রশিক্ষণ না নেয়া শিক্ষকদের তালিকা চাওয়া হয়েছে।

মাউশি অধিদপ্তর বলছে, প্রশিক্ষণে পাওয়া জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষক সহায়িকা অনুসারে ক্লাস না নেয়া শৃঙ্খলা পরিপন্থি। যেসব শিক্ষক সরকারি নির্দেশনা না মেনে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর নতুন শিক্ষাক্রমের ক্লাস নিচ্ছেন তাদের তথ্য জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে মাউশিতে তথ্য পাঠাতে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বলা হয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষকদের সতর্ক করে সংস্থাটি গত ১৮ জুন একটি নির্দেশনা জারি করেছে।


এ বিষয়ে মাউশির ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক একেএম আবদুল খালেক গতকাল বলেন, ‘ইতোমধ্যে মাধ্যমিকের শিক্ষকরা দুই দফা বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তৃতীয় দফা প্রশিক্ষণ চলমান। এর পর কেউ প্রশিক্ষণের বাইরে থাকার কথা নয়; নতুন শিক্ষাক্রম না বুঝারও কথা নয়।’


তাহলে মাউশি প্রশিক্ষণ না নেয়া শিক্ষকদের তালিকা চেয়েছে কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খণ্ডকালীন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাদ রয়েছে। আমি আজ মানিকগঞ্জে এসেছি.... এখানে কেউ প্রশিক্ষণের বাইরে নেই। সবাই নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকেই শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন করছেন।’


জানতে চাইলে মানিকগঞ্জের একটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর শিক্ষকরা যথেষ্ট প্রশিক্ষণ পাননি। যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তারাও বিষয়টি ঠিকমতো বোঝাতে পারেননি। এ কারণে বেশিরভাগই প্রচলিত নিয়মে পরীক্ষা নিচ্ছেন।

‘চাপিয়ে দেয়া’ নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এখন শ্রেণী কক্ষে পুরোপুরি মূল্যায়ন সম্ভব হবে না দাবি করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের আরও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরাও বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারছে না। এ কারণে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে।’


মাউশি জানিয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শুধু মাধ্যমিক স্তরেই চার লাখ ১৮ হাজার শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। এর মধ্যে এ পর্যন্ত দুই হাজার ৮০ হাজারের মতো শিক্ষকের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি এক লাখ ৩৭ হাজারের মতো শিক্ষক এখনও প্রশিক্ষণই পাননি।

মাউশির ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বিষয়ভিত্তিক ‘ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন’ নির্দেশিকা অনুযায়ী, গত ৩১ মে থেকে ৬ জুন পর্যন্ত প্রস্তুতি নিয়ে ৭ থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন সম্পন্ন করতে শিক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হয়।

কিন্তু মাউশি জানতে পায়- বেশিরভাগ স্কুলেই পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। শ্রেণী কক্ষে শিখন শেখানো কার্যক্রমের মূল্যায়ন হচ্ছে না। এ কারণে এবার কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ যারা নতুন শিক্ষাক্রম ‘পরিপন্থি’ কার্যক্রম চালাচ্ছেন তাদের তালিকা চাওয়া হয়েছে।

মাউশির সহকারী পরিচালক এসএম জিয়াউল হায়দার হেনরী স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, মাউশি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে পাঁচদিনের প্রশিক্ষণ, শিক্ষক সহায়িকা, মূল্যায়ন নির্দেশিকা দিয়েছে।

এছাড়া মুক্ত পাঠের মাধ্যমে মূল্যায়ন সংক্রান্ত অনলাইনে কোর্স সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন কোন শিক্ষক তা অনুসারে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন না, যা চাকরি শৃঙ্খলার পরিপন্থী।

মাউশির আদেশে শিক্ষকদের শ্রেণী পাঠদান ও মূল্যায়ন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ লব্ধজ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষক সহায়িকা অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। যেসব শিক্ষক প্রশিক্ষণ লব্ধজ্ঞান ও শিক্ষক সহায়িকা অনুসারে পাঠদান করছেন না তারা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধান এজন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন বলে মাউশি সতর্ক করেছে।

এ বিষয়ে ‘বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদের’ সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও শরীয়তপুরের একটি বেসরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল হোসেন মিলন বলেন, তার জানা মতে, সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ স্কুলে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ‘শিখন শেখানো’ কার্যক্রম মূল্যায়ন হচ্ছে।

বাকি ৯০ শতাংশ স্কুলে অর্ধবাষিক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘প্রথমত পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই এ কার্যক্রম চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষক বিষয়টি বুঝতে পারছে না। দ্বিতীয়ত পরীক্ষা না নিলে নোট-গাইড বই বিক্রি হবে না। এতে প্রকাশকদের যেমন ক্ষতি, তেমনি শিক্ষকদেরও ক্ষতি।’

পরীক্ষা নেয়ার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধানের ওপর প্রকাশকদের চাপ রয়েছে বলেও আবুল হোসেন মনে করছেন।

মাউশির একটি বিশেষ প্রোগ্রামের ‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিমের’ আওতায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিষয়ে গত ৩১ মে মাউশিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ওই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক স্তরের ‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিমের’ আওতায় গত মে পর্যন্ত ২৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট স্কিম বরাদ্দের ৭০ দশমিক ২০ শতাংশ।

স্কিম পরিচালক সৈয়দ মাহফুজ আলীর বরাত দিয়ে কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘নতুন কারিকুলামে প্রশিক্ষণের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদান করেন এমন চার লাখ ১৮ হাজার শিক্ষকের প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও বাস্তবে অনুমোদিত শিক্ষকের সংখ্যা কম।’

অন্যদিকে চলমান প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের বাইরে রয়ে গেছে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষক, যারা নির্ধারিত সময়ে বিভিন্ন কারণে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে পারেনি বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

বাদ পড়া এসব শিক্ষকের প্রশিক্ষণের বিষয়ে মাহফুজ আলী বলেন, ‘কক্ষ সংকট থাকায় স্কিমের কার্যক্রম পরিচালনায় সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।’

চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় এবং মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছে। এরপর ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। শিক্ষাবর্ষের অর্ধেকের বেশি অতিবাহিত হলেও সব শিক্ষকের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়নি। অথচ ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো- ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার পরিবর্তে শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন করা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031969547271729