দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো রয়েই গেছে। মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে কমিটি গঠন হলেও কাজের গতি কম। অভিভাবকরা বলেছেন, হাতে-কলমে লিখিত পরীক্ষা ও এর মূল্যায়ন না থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অগ্রগতি বুঝতে পারছেন না তারা। আর শিক্ষা গবেষকরা শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়নের পাশাপাশি সীমিত পরিসরে লিখিত পরীক্ষাও রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। শনিবার (১৬ মার্চ) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় সংশ্লিষ্টদের মতে, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সমালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে দেদার। এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৪ জানুয়ারি ভুল সনাক্তে ৫ সদস্যের কমিটি করা হয়। কিন্তু এখনো এর প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। এরপর গত ৫ মার্চ পাবলিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় মূল্যায়ন পদ্ধতি কেমন হবে- তা নিয়ে ১৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির কার্যকক্রমের গতিও অনেক কম। যদিও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, কমিটির কার্যক্রম চলছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, অচিরেই কমিটির রিপোর্ট পেয়ে যাব। এর ভিত্তিতে সংশোধনের যে প্রক্রিয়া তা চলতে থাকবে। আমরা মার্চের শেষের দিকে এই সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করব।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমান শিক্ষাক্রমে শিখন-শেখানো পদ্ধতি অত্যন্ত আধুনিক হলেও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে শুরু থেকেই অসন্তোষ বিরাজ করছে অভিভাবকদের একটি অংশের মধ্যে। অভিভাবকরা বলেছেন, কাগজে কলমে মূল্যায়ন না থাকায় শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয়ে ভালো বা দুর্বল তা বোঝা যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে অনেক শিক্ষকও মূল্যায়নের ‘নৈপূণ্য’ অ্যাপস ব্যবহার করতে পারছে না। এজন্য মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষা গবেষক, শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন নাগরিক সমাজের একাংশ। অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে ভালো স্কোর করল বা খারাপ করল- সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়ার সুযোগ নেই অভিভাবকদের। শিক্ষকরা সঠিক মূল্যায়ন করলেন কিনা তাও বোঝার উপায় নেই। ক্লাসের জন্য নির্ধারিত পাঠের মূল্যায়ন সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা সেটি আর পড়ার বা রিভিশন দেয়ার প্রয়োজন মনে করছে না। আবার সামষ্টিক মূল্যায়ন দলীয় কার্যক্রমভিত্তিক হওয়ার ফলে আলাদা আলাদাভাবে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত উৎকর্ষ যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। সর্বোপরি, শিক্ষার্থীদের লেখার দক্ষতা হারিয়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক বলেন, আগে স্কুল থেকে একটি অংক বা প্রশ্ন বলে দিত। বাসা থেকে করে আনার জন্য। এখন সেটাও নেই। আরেকজন অভিভাবক বলেন, এখন পড়ার সিষ্টেম অন্যরকম। এতে বোঝারও সমস্যা হচ্ছে।
শিক্ষা গবেষকরা বলেছেন, শিক্ষাক্রমের সঙ্গে অভিভাবকদের সংযুক্ত করতে হয়। যদিও নতুন শিক্ষাক্রমে সেই সুযোগ রাখা হয়নি। উল্টো একেবারেই লিখিত পরীক্ষা বাতিল করায় শিক্ষার্থীদের ওপর নেতবিাচক প্রভাব পড়ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের সহযোগী অধ্যাপক শাহ শামীম আহমেদ বলেন, শ্রেণিকক্ষে দেয়া এসাইনমেন্টগুলো কি আমরা ঠিকঠিক মূল্যায়ন করছি, মার্কিং করছি? অথবা মার্কিং না করেও শিক্ষার্থীদের বোঝানো- তোমার এটা হয়েছে, আমরা কি এটা করছি? হয়েছে কি হয়নি, কোনো জায়গায় গ্যাপ
আছে, আমরা কি সেটা বলছি? সব মিলিয়ে শিশুদের কি ফিডব্যাক দিতে পারছি?
এদিকে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী জানান, অভিভাবকরা যাতে করে সহজে বুঝতে পারেন; সে জন্য মূল্যায়ন পদ্ধতি সহজ করা হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা বাদ দিতে এবং চাপমুক্তভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার স্বার্থেই নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া সেই বক্তব্যের সূত্র ধরে গত ৪ মার্চ নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটির কাজ হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সুপারিশ ও মতামত দেয়া, পাবলিক পরীক্ষাসহ মূল্যায়ন পদ্ধতি পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করতে সুপারিশ দেয়া, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, সংশোধন, পরিমার্জন বিষয়ে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা। কিন্তু সমন্বয় কমিটির কাজের অগ্রগতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এখন পর্যন্ত একটি সভাও করতে পারেনি গঠিত কমিটি। এর ফলে লিখিত পরীক্ষা হবে কিনা, হলেও কীভাবে হবে, তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা এখনো পাওয়া যায়নি। এরকম পরিস্থিতির মধ্যেই চলতি শিক্ষাবর্ষের সাড়ে তিন মাস পার হয়েছে। অধিকাংশ স্কুলে পদ্ধতিগতভাবে শিখনকালীন মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপে নিয়মিত ইনপুট দেয়ার কথা থাকলেও সিংহভাগ স্কুলের শিক্ষকরাই তা করছেন না। এছাড়া ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দের মাধ্যমিক পরীক্ষা কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়েও উৎকণ্ঠা রয়েছে অভিভাবকদের মধ্যে, যা চাপা ক্ষোভে রূপ নিচ্ছে ক্রমশ।
জানতে চাইলে এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষার পদ্ধতি বিধায় এতে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে মূল্যায়নের সুযোগ নেই। পাশাপাশি সামষ্টিক মূল্যায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, একদিনে একাধিক বিষয়ের মূল্যায়ন করতে গেলে তা ঠিকমতো হয় না। তাই এখন একদিনে একটি বিষয়ের পুরো মূল্যায়ন করা হবে। প্রথমে ওরিয়েন্টশেন দেয়া হবে, তারপর একজন শিক্ষার্থী ফাইনাল কাজটি করবে। দলগতভাবে একটি কাজ করা হবে, আবার প্রত্যেককে এককভাবে পারফর্ম করতে হবে। প্রতিদিন ৫ ঘণ্টায় এই কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, মূল্যায়নে যে কাজটা করতে দেয়া হবে, তার বর্ণনা হয়তো লিখতে হবে। কিংবা একটা ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ লিখতে দেয়া হবে। সেটা ওখানেই লিখতে হবে। কখনই আগের মতো হবে না, যে বই থেকে বা গাইড থেকে পড়ে মুখস্থ করে গেলাম আর লিখে দিলাম। শিক্ষার্থীকে কাজটা করতে হবে এবং বর্ণনা লিখতে হবে নিজের মতো করে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতিতে গাইড-কোচিং ব্যবসা বন্ধের কথা বলা হলেও সেটি আরো বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে, কারিকুলাম ভালোভাবে বোঝেন যেসব শিক্ষক তাদের কাছে প্রাইভেট পড়া বা কোচিং করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। স¤প্রতি ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের একজন গণিতের মাস্টার ট্রেইনার শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। তবে সারাদেশে শিক্ষকদের কোচিং না করাতে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। গত সোমবার মাউশি থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলাম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন সংক্রান্ত এক নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন কারিকুলামে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ ক্লাসের নামে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানো বা কোচিংয়ে বাধ্য করানো হলে প্রতিষ্ঠান প্রধান ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন মাধ্যমিক স্তরের কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ ক্লাসের নামে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানো হচ্ছে বা কোচিংয়ে বাধ্য করানো হচ্ছে। এছাড়া কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলাম বিস্তরণ ও মূল্যায়নের সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও তা লঙ্ঘন করে সাপ্তাহিক বা মাসিক মূল্যায়নের নামে গতানুগতিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। এতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন বিঘিœত হচ্ছে। কোচিংসহ এসব কার্যকলাপ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিরত রাখা এবং নতুন কারিকুলাম যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এর আগে জারিকৃত নির্দেশনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।
তবে মাউশির এমন নির্দেশনার পরও ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার একাধিক স্কুলে শিক্ষকরা মূল্যায়নে ভালো করতে হলে তাদের কাছে পড়ার জন্য চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। অর্থাৎ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় যে ত্রæটি রয়েছে তা সংশোধন করতে হবে, এটি সময়ের দাবি হয়ে উঠছে। মূল্যায়নের ত্রæটি সমাধান না করা হলে অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ চরমে উঠবে বলে মনে করছেন শিক্ষা গবেষকরা।
এনসিটিবি বলছে সামষ্টিক মুল্যায়ন হবে নির্দিষ্ট দিনে ৫ ঘণ্টাব্যাপী। আবার বলছে নির্দিষ্ট সময় ধরে কোনো পরীক্ষা থাকার সুযোগ নেই নতুন কারিকুলামে। এ ধরনের বক্তব্য শিক্ষক-অভিভাবক মহলে অসন্তোষ ছড়াচ্ছে, যা কারিকুলামকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, লিখিত দক্ষতা মূল্যায়ন করতে সীমিত আকারে লিখিত বা হাতে-কলমে পরীক্ষা সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য নির্ধারিত সময়ের ভেতর থাকতে পারে। আর এটির নম্বর প্রদান প্রক্রিয়া নতুন পদ্ধতি অনুসারে নৈপুণ্য অ্যাপে ইনপুট দেবেন শিক্ষকেরা। কিন্তু এনসিটিবি সবকিছু ধোঁয়াশা করে রেখেছে। মার্চ মাস চলে যাওয়ার পথে, মূল্যায়ন শুরুই করতে পারেনি।