ধারাবাহিক বা সামষ্টিক মূল্যায়ন আলোচনা করার আগে পরিমাপ ও মূল্যায়ন সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। পরিমাপ হলো কোনো কিছুর পরিমাণ নির্ণয় করা। কিন্তু শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞানে পরিমাপ ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞানে ইংরেজি ‘Measurement; কথাটির অর্থ হলো, ‘Quantification of test results’ অর্থাৎ অভীক্ষার ফলের পরিমাণগত প্রকাশই পরিমাপ। আসলে পরীক্ষার ফলকে সংখ্যায় প্রকাশ করার প্রক্রিয়াই হলো পরিমাপ। গ্রণল্যান্ড ও লিন পরিমাপ সম্পর্কে বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য কতোটুকু রয়েছে তার সংখ্যাগত বর্ণনা লাভের প্রক্রিয়াই হলো পরিমাপ। এবার আসি মূল্যায়ন বলতে কী বুঝায়? সাধারণ অর্থে মুল্যায়ন বলতে মুল্য আরোপ করা বুঝায়। বিভিন্ন শিক্ষা বিজ্ঞানী মুল্যায়নকে বিভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। টাকম্যান মূল্যায়নকে বর্ণনা করে বলেছেন-মূল্যয়ন হলো সেই প্রক্রিয়া যার সাহায্যে কোনো প্রোগ্রামে বিবৃতে উদ্দেশ্য অনুযায়ী আমাদের নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসারে বা আমাদের মানের উৎকর্ষতা অনুযায়ী প্রোগ্রামটির কার্য প্রক্রিয়া বা ফল কতোটুকু সন্তোষজনক তা পরীক্ষা বা যাচাই করা যায়। সুতরাং মূল্যায়ন হলো এমন একটি ক্রিয়া বা প্রক্রিয়া যার সাহায্যে আমরা আমাদের প্রত্যাশা বা পরিমাপের মূল্য সম্পর্কে বিচার করতে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা পেতে পারি। যদি এক কথায় মুল্যায়ন সম্পর্কে বলা যায়- ‘কোনো কিছুর মুল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়াকেই বলা হয় মূল্যায়ন’।
মূল্যায়ন ও পরিমাপ এর মধ্যে নিম্নরূপ সম্পর্ক দেখা যায়-মূল্যায়ন হলো ব্যাপক কিন্তু পরিমাপ এর অন্তর্ভুক্ত একটি অংশ। পরিমাপ হলো কোন শিক্ষার্থীর কৃতিত্বের সংখ্যাগত প্রকাশ। আর মূল্যায়ন হলো শিক্ষার্থীর অর্জিত কৃতিত্ব কতটুকু উত্তম বা সন্তোষজনক তার গুণগত বিচার। মূল্যায়ন পরিমাপের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু পরিমাপ ও মূল্যায়ন সমার্থক নয়। এবার আসি শিক্ষা মূল্যায়ন বলতে কি বুঝায়, গ্রণল্যান্ড ও লিন শিক্ষা মূল্যায়নের নিম্নরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন-শিক্ষণ উদ্দেশ্যে কতটুকু শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে পেরেছে তা নির্ণয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হল মূল্যায়ন। মূল্যায়নের এই সংজ্ঞাটিকে আরো বিশ্লেষণ করে বলা যায়-মূল্যায়ন হলো এমন একটি ধারাবাহিক অবিরত প্রক্রিয়া যার সাহায্যে নির্ণয় করা যায়-পূর্বে শনাক্তকৃত ও বর্ণিত শিক্ষার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যগুলো কতোটুকু অর্জিত হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে প্রদত্ত লিখন অভিজ্ঞতা বা পাঠদান কতোটুকু কার্যকর হয়েছে। শিক্ষার লক্ষ্যগুলো কত উত্তম ভাবে অর্জিত হয়েছে। তা হলে আমরা আরো বলতে পারি, মূল্যায়ন একটি ধারাবাহিক ও পদ্ধতিগত ও অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। শিক্ষণ শিখন প্রক্রিয়া ও মূল্যায়ন পাশাপাশি চলে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয় যে, শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলো পূর্বেই শনাক্ত ও বর্ণনা করা হয়েছে। মূল্যায়নের সঙ্গে তথ্য সংগ্রহের বিভিন্ন প্রকার পদ্ধতি ও অভিক্ষা জড়িত শিক্ষণের চেয়ে শিখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার উদ্দেশ্য অনুসারে শিখন অভিজ্ঞতা এমন প্রাসঙ্গিক হতে হবে যেন এগুলো শিক্ষামূলক উদ্দেশ্য অর্জনের দিকে শিক্ষার্থীকে পরিচালিত করে শিক্ষার্থীর আচরণ সম্পর্কে প্রমাণ সংগ্রহের সবগুলো উপায় কাজে লাগায়। মূল্যায়ন বর্ণনামূলক ও পরিমাণগতও বটে। মূল্যায়ন ৪টি বিষয়ের সঙ্গে জড়িত উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, শিখন অভিজ্ঞতা, মূল্যায়ন কৌশল ও উপকরণ। মূল্যায়ন কেনো দরকার? এর উত্তরে বলা যায় ত্রুটিহীন, যুক্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু শিক্ষামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মুল্যায়ন প্রয়োজন। শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা কি লাভ হবে বা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সমাজ, জাতি ও দেশ কি পাচ্ছে তা মূল্যায়নের ফলাফল থেকেই জানা সম্ভব।
মূল্যায়ন শিক্ষাক্রম উন্নয়নে সহায়তা করে। উত্তম মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষার লক্ষ্যকে ব্যাখ্যা ও সুষ্পষ্টকরণে সহায়তা করে। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যথোপযুক্ত শিখন অভিজ্ঞতা পরিকল্পনা করার পরবর্তী ধাপটি হলো শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা। শিখনের ফলে শিক্ষার্থীর মধ্যে কি পরিবর্তন ঘটলো বা কি শিখন ফল পাওয়া গেলো তা শিক্ষক পর্যবেক্ষণ করে মুল্যয়ন করেন বা পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর কৃতিত্ব পরিমাপ করতে পারেন। এই জন্য তাকে মূল্যায়নের সঠিক কৌশল নির্বাচন অথবা উদ্ভাবন করতে হবে। মূল্যায়নের সময় শিক্ষককে তিনটি বিষয় মনে রাখতে হবে-উদ্দেশ্য, প্রাসঙ্গিক শিখন বিষয় ও শিখন কার্যাবলী। কিন্তু সব সময়ই মূল্যায়নের কেন্দ্রবিন্দু থাকবে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উপর। এ কাজটি তিনি প্রাসঙ্গিক শিক্ষণ বিষয়ের তালিকা তৈরি এবং শিখন কার্যাবলীর পরিকল্পনা না করে করতে পারবেন না। শিক্ষক যে শিখন কর্যাবলী উপস্থাপন করেন তার থেকে শিক্ষার্থী শিখন অভিজ্ঞতা লাভ করে।
যে প্রাসঙ্গিক শিক্ষনীয় বিষয় নিয়ে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে আলোচনা করেছেন এবং শ্রেণি শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থীরা যে শিখন অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তার অধিকাংশকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষক অভীক্ষা তৈরি করতে পারেন। তিনি নিতে পারেন কোনো মৌখিক পরীক্ষা বা লিখিত পরীক্ষা এ ছাড়াও তিনি ব্যবহারিক পরীক্ষাও নিতে পারেন। তিনি তৈরি করতে পারেন নৈর্ব্যক্তিক অভীক্ষা বা রচনামূলক অভীক্ষা বা কোনো পর্যবেক্ষণ ছক। যে অভিক্ষাই তিনি তৈরি বা নির্বাচন করেন না কেনো? তাকে মনে রাখতে হবে সেটি যেনো সর্বোত্তমভাবে উদ্দেশ্য, প্রাসঙ্গিক শিক্ষনীয় বিষয় ও শিক্ষার্থীর শিখন অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করে। উপরোক্ত ধাপটি ছাড়াও আরো পাঁচটি ধাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা যায়-সাধারণ উদ্দেশ্য শনাক্ত করণ ও তার বর্ণনা। বিশেষ উদ্দেশ্য সমূহ শনাক্তকরণ ও বর্ণনা। প্রাসঙ্গিক শিখন-বিষয় নির্বাচন। যথোপযুক্ত শিখন কার্যাবলী পরিচালনা এবং ফিডব্যাক বা ফলাবর্তন হিসাবে মুল্যায়নের ফলের ব্যবহার। মূল্যায়নের স্বরূপ ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে মূল্যায়ন তিন রকমের হতে পারে। শিখনের মূল্যায়ন, শিখনের জন্য মূল্যায়ন এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে শিখন। প্রথম ধরনের মূল্যায়নে শুধুমাত্র শিখনের পরিমাপ করা হয়, দ্বিতীয় ধরনের মূল্যায়নে ধারাবাহিক বা চলমান মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি বুঝে সে অনুযায়ী বর্ণনামূলক ফিডব্যাক দেয়া হয়। আর তৃতীয় ধরনের মূল্যায়নে এমন হয় যে, সেই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শুধুমাত্র শিখন অগ্রগতি পরিমাপ ও ফিডব্যাক প্রদানই করে না বরং শিক্ষার্থীর জন্য শিখন অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজ করে। পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমে নতুন এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি শিখনের জন্য মূল্যায়ন। (Assessment for learning) এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে শিখন (Assessment as learning) কে প্রাধান্য দিয়ে সাজানো হয়েছে। শিখন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়ার সময়ে নিয়মিত ফিডব্যাক প্রদানের মাধ্যমে শিখনে সহায়তা করার যে পদ্ধতি তা-ই শিখনকালীন মূল্যায়ন নামে পরিচিত। অর্থাৎ শিখনকালীন মূল্যায়ন হলো শিখন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সন্নিবেশিত ধারাবাহিক মূল্যায়ন, যার উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর শিখন অবস্থা জেনে শিখনে সহায়তা করা। কিন্তু, কিছু ক্ষেত্রে এ মূল্যায়নের তথ্য ও উপাত্ত যোগ্যতার বা পারদর্শিকতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রমাণ দেয়। এই কারণে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার সময় শিক্ষার্থীদেরকে যেসব কাজ বা অভিজ্ঞতা বা কার্যক্রম করানো হবে সেগুলো অবশ্যই শিক্ষককে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং শিক্ষার্থীর উন্নয়নের জন্য পরামর্শ বা উৎসাহ প্রদানের জন্য মন্তব্য করতে হবে এবং এগুলোর প্রমাণাদি সংরক্ষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরবর্তীতে এ ফলাফল সামষ্টিক মূল্যায়নের সঙ্গে সমন্বিত করে সার্বিক মূল্যায়ন ও তার প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যবহৃত হবে।এ মূল্যায়ন পুরো শিক্ষাবছরব্যাপী শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চলমান থাকবে। ধারাবাহিক মূল্যায়নের প্রক্রিয়া বা ধাপ সমূহ হলো-পরিকল্পনা প্রণয়ন, মূল্যায়ন কৌশল ও টুলস নির্বাচন, মূল্যায়ন পরিচালনা ও তথ্য সংরক্ষণ এবং সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ ও কার্র্যকর ফলাবর্তন প্রদান। একজন শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিত কল্পে শিখনের ৩টি ক্ষেত্র-জ্ঞান, মনোপেশীজ এবং আবেগিক ক্ষেত্রের ওপর ভিত্তি করে ধারাবাহিক মুল্যায়ন করা হবে। ধারাবাহিক মূল্যায়নের প্রয়োগক্ষেত্র ৩টি- জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ। প্রতিটি প্রয়োগক্ষেত্রের আবার কয়েকটি উপক্ষেত্র রয়েছে জ্ঞানের প্রয়োগক্ষেত্রের উপক্ষেত্র হলো জানা, অুনধাবন ও প্রয়োগ। আবার দক্ষতার উপক্ষেত্র সমূহ হলো সৃজনশীলতা, চিন্তন, যোগাযোগ ও সহযোগিতা। একইভাবে মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি উপক্ষেত্র সমূহের কয়েকটি হলো সহমর্মিতা, পরমতসহিঞ্চুতা, আগ্রহ ও কৌতুহল ইত্যাদি। ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিভিন্ন কৌশল ও টুলস্ হলো-মৌখিক প্রশ্নোত্তর, লিখিত প্রশ্নোত্তর, পর্যবেক্ষণ (একক ও জোড়ায় কাজ, দলগত কাজ, প্রকল্প ব্যবহারিক কাজ ইত্যাদি)। সাক্ষাৎকার, স্ব-মূল্যায়ন, সতীর্থ/সহপাঠী কর্তৃক মূল্যায়ন। তবে আমাদের সবার মনে রাখতে হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন কোনো আনুষ্ঠানিক মূল্যায়ন নয়। তাই এই মূল্যায়নের জন্য আলাদা কোনো আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা নেয়া যাবে না। ধারাবাহিক মূল্যায়নের মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীকে তার শিখনে সহায়তা করা। শিখন-শেখানে কার্যাবলী চলাকালে প্রয়োজনীয় ফলাবর্তনের মাধ্যমে এই শিখন নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে স্বাভাবিক ও আনন্দময় পরিবেশে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করবেন।
পর্ব-১
লেখক: মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, উপজেলা মাস্টার ট্রেইনার ও সিনিয়র শিক্ষক, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুমিল্লা
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।