১৯২৯ সালের ২৩ জুলাই কবি সুফিয়া এন হোসেন তৎকালীন 'সওগাত' পত্রিকার প্রখ্যাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, 'আমি আমার কাজ করে যাব নীরবে, নিঃশব্দে। আমি পথের কাঁটা সরিয়ে যাব- এরপর যাঁরা আসবে যেন কাঁটা না ফুটে তাঁদের পায়ে, তাঁরা যেন কণ্টকবিদ্ধ পদে পিছিয়ে না পড়ে। ওইটুকু আমি করব আমার যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে।' ভাবতে অবাক লাগে, বিস্মিত হই, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর! তখন সমাজ, পরিবারে বাঙালি মুসলিম নারীর শিক্ষা মুষ্টিমেয় পরিবার ব্যতীত কেউ সুনজরে দেখত না। সমাজে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি ছিল অনুপস্থিত। যদিও এর আগেই প্রাতঃস্মরণীয় রাজা রামমোহন রায় অনেক শাস্ত্রীয় ও আইনি লড়াই করে অমানবিক 'সতীদাহ প্রথা' রদ করেছেন। সোমবার (২০ জুন) দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 'বিধবা বিবাহের প্রচলন', নারী শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং পুস্তক রচনা করেছেন। নারীমুক্তির পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত 'সুলতানার স্বপ্ন' ইংরেজিতে রচনা করেছেন। এতদ্সত্ত্বেও সমাজ-সংসারে প্রচলিত নানা কুসংস্কার ও প্রথা নারীকে পদে পদে গৃহের অভ্যন্তরে বেঁধে রেখেছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে সামনে এগোতে দেয়নি। সেই সময়ে কী দীপ্র অহংকারে তিনি এই সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন! শুধু তাই নয়; আজীবন তিনি এই উক্তি নিজের জীবনে সত্য করে তুলতে কাজ করে গেছেন এবং তা সত্য করে তুলেছিলেন।
বাংলাদেশের প্রায় সব প্রগতিশীল, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, গণতান্ত্রিক, নারী অধিকার ও মুক্তির আন্দোলনে পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে মামাতো ভাই নেহাল হোসেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এ সময় তিনি পত্রিকার পাতায় সুফিয়া এন হোসেন নামে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। এ বিষয়ে স্বামী তাঁকে উৎসাহ দিতেন। 'সৈনিক বধূ' নামে প্রথম গল্প ছাপা হয় ১৯২৩ সালে বরিশাল থেকে প্রকাশিত সরল কুমার দত্ত সম্পাদিত 'তরুণ' পত্রিকায়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ 'কেয়ার কাঁটা'। ১৪টি গল্প ও একটি নাটক এ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। তখন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম নারীদের রচিত গল্পের সংখ্যা ছিল খুবই কম। শুধু তাই নয়; বাংলা সাহিত্যেও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্যতীত ছোটগল্পের পরিধি ছিল সীমিত। ১৯৩৭ সালে কলকাতা থেকে গ্রন্থটি কবি বেনজীর আহমদ প্রকাশ করেছিলেন।
১৯২৫ থেকে '২৯ সাল পর্যন্ত সুফিয়া এন হোসেন কলকাতায় 'অল ইন্ডিয়া উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন' ও 'আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম'-এর সদস্য হয়ে কাজ করেছেন। ১৯৩২ সালে সুফিয়া এন হোসেনের স্বামীর মৃত্যু হয়। বরিশালে ফিরে আসেন তিনি। পরে কলকাতায় ফিরে যান নিজ সিদ্ধান্তে। শিশুকন্যা ও মাকে নিয়ে তাঁর আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সংগ্রাম শুরু হয়। অভিজাত মামাবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে কলকাতায় ফিরে কলকাতা করপোরেশন স্কুলে দীর্ঘ ছয় বছর ৫০ টাকা বেতনে শিক্ষকতা করেন। পাঁচ বছর পর উদার মানসিকতার প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব কামালউদ্দিন খানের সঙ্গে কবি সুফিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি সুফিয়া কামাল নামে লেখা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন এবং এ নামেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। কবি সুফিয়া কামালের জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে আজ।
ভারত ভাগ-পূর্ব সময়ে ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে'তে দাঙ্গার সময় পার্ক সার্কাস এলাকায় ত্রাণকাজে সুফিয়া কামাল অংশ নিয়েছিলেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। বর্ধমানে 'মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি'র মিছিলে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সরকার এ সমিতি বন্ধ করে দেয় ১৯৪৮ সালে। সুফিয়া কামাল অখণ্ড ভারত ভাগ হয়ে যাওয়ার পর ঢাকায় চলে আসেন। নারীর কল্যাণ ও মুক্তির জন্য গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি (১৯৪৮), ঢাকা শহর শিশুরক্ষা সমিতি (১৯৫১), নারী কল্যাণ সংস্থা (১৯৬৫), ওয়ারী মহিলা সমিতি (১৯৫৪), মহিলা সংসদ (১৯৬৬) এবং ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। তিনি উল্লিখিত সংগঠনগুলোর সভানেত্রী ছিলেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আজীবন সভানেত্রী হিসেবে এদেশে সমাজ, সংসার, রাষ্ট্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় দুর্বার নারী আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং আজও সেই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে ধারাবাহিকভাবে।
আজ নারী উন্নয়ন দৃশ্যমান এবং মানবের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অনেক অধিকার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শতভাগ না হলেও অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এও সত্য- নারী নির্যাতন কমেনি। লেখায়, সংগ্রামে জননী-সাহসিকা সুফিয়া কামাল সারাজীবন একজন সত্যিকারের মানুষ হওয়ার সাধনা করে গেছেন। তাঁর প্রতিবাদ, অন্যায় প্রতিরোধের আন্দোলন স্মরণ করলে তাঁর পথ ধরে চলা নারী-পুরুষ সবার অর্থাৎ আমাদেরই মঙ্গল। জন্মদিনে তাঁকে জানাই অন্তর্ময় শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : কাজী সুফিয়া আখ্তার, নারী অধিকার কর্মী, গবেষক ও লেখক