মা! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্বোধন। আমার মা নেই আজ প্রায় ১৪ বছর। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ আগস্ট ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মা আছিয়া খাতুন প্রয়াত হন। তার মৃত্যুর পর এই প্রথম তাকে লিখে স্মরণ করছি গভীর বেদনা ও শ্রদ্ধায়।
আমাদের বাস ছিলো রংপুর শহরের সেন্ট্রাল রোডে বামনডাঙ্গা জমিদার বাড়ি সংলগ্ন স্থানে। আর গ্রামের বাড়ি ছিলো রংপুরের পীরগঞ্জ থানার রসুলপুর। আমার মা ছিলেন রংপুর শহরের সর্বজনবিদিত একজন বিশিষ্ট সমাজ সেবিকা। দুঃস্থ ও অসহায় নারীদের সামাজিক উন্নয়ন, বয়স্ক শিক্ষার প্রসার ও অবহেলিত গরিব শিশুদের শিক্ষাদানই ছিলো তার জীবনের প্রধান ব্রত। অথচ তিনি ছিলেন স্বল্পশিক্ষিত। প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের চার ভাই এক বোনকে শিক্ষিত করে তুলেছেন। আমার বাবা ছিলেন স্বল্প আয়ের সরকারি চাকরিজীবী। তিনি আমার মাকে সব সময়ই তার সব সমাজসেবামূলক কাজে সহযোগিতা এবং উৎসাহ দিয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছেন তার পুত্র-সন্তানদের। আমরা যখন শিশু সংগঠন মুকুলফৌজ অথবা খেলাঘরের কর্মকাণ্ডে বা পাড়ার ক্লাব অথবা শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠনে ও কর্মকাণ্ডে বা স্কুল ছেড়ে যখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে রাস্তার আন্দোলনে যুক্ত হই, তিনি উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি সন্তানদের সাহস যুগিয়েছেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণে, স্বাধীনতা আন্দোলনে ও স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণে। আমার প্রয়াত ছোট ভাই মারুফ চিনু যখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, তখন তাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা লিখে দিতেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার জন্য। অথচ আমার বাবা কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
স্বাধীনতার পর আমাদের সরকারি বাসার একটি টিনশেড কক্ষ থেকে আমার মা রংপুর শহরে প্রথম চালু করেন বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র। এর মধ্য দিয়ে অনেক বয়স্ক নারী ও পুরুষরা স্বাক্ষর জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর তিনি এবং আমাদের পাড়ার অপর দুজন রংপুরের বিশিষ্ট সমাজ সেবিকা প্রয়াত মালেকা আশরাফ ও প্রয়াত ইসমত আনোয়ার- এই তিনজনের উদ্যোগেই ‘রংপুর মহিলা কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন সমবায় সমিতি’ গঠিত হয় ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে। এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষ পীড়িত দুঃস্থ পরিবারদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো এবং সাধ্যমত সেবা ও সহযোগিতা করেছিলো। সমাজের বিত্তবান, গুণীজন এবং সমিতির সদস্যদের চাঁদা ও আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে সংস্থাটি পরিচালিত হয়। উল্লেখিত প্রয়াত তিনজন সমাজ সেবিকার উদ্যোগে ও কঠোর শ্রমে সমিতির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘দুঃস্থ শিশুকল্যাণ বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিলো অসহায় দুঃস্থ, মাতৃ-পিতৃহীন ভবঘুরে শিশুদের শিক্ষাদান ও বৃত্তিমূলক কাজের মাধ্যমে তাদের স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা।
ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা কার্যকরী কমিটির সম্পাদক ছিলেন আমার মা এবং সভানেত্রী ছিলেন মালেকা আশরাফ। বিদ্যালয় গঠনের শুরুতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ৩০ জন। কিন্তু পরবর্তীতে তা ৪২৫ জনে উন্নীত হয়। সব শিক্ষার্থীকে বিনা বেতনে অধ্যয়ন, স্কুল ড্রেস, বই-খাতা, টিফিন ইত্যাদির ব্যবস্থা সমিতি থেকেই করা হয়।
তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ের জন্য সমিতি থেকে কেনা জমিতে পরবর্তীকালে দোতালা পাকা স্কুল ঘর নির্মিত হয়। সরকারের কোনো আর্থিক অনুদান ছাড়াই রংপুর শহরের সাধারণ মানুষের আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে স্কুলের যাবতীয় খরচ সবসময় মেটানো হয়। সেই দোতালা স্কুল ভবনটি আজও অতীতের সব সংগ্রামমুখর ঘটনার সাক্ষী। নেই শুধু ওসব দুঃস্থ শিশুর স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার ও কারিগর আমার মা, যিনি সমাজসেবা ছাড়া অন্য কোনো কাজে অথবা সরাসরি কখনই কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন না। আমার মা আমৃত্যু ওই স্কুল পরিচালনা ও সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর স্কুলটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি রংপুরের শালবন পাড়ার আরেকজন বিশিষ্ট সমাজসেবক অধ্যাপক আরিফ হোসেন (টিটো) স্কুলটিকে পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন। আমি তার এই উদ্যোগের সার্বিক সফলতা ও সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি।
লেখক : মর্তুজা আহমদ চিশতী, উপদেষ্টা সম্পাদক, এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার