নীতির বাধায় যেন ক্যাশলেস বাংলাদেশের স্বপ্ন ব্যাহত না হয়

দৈনিকশিক্ষাডটকম ডেস্ক |

দেশের সামগ্রিক লেনদেনের তিন-চতুর্থাংশ ছাপা টাকাহীন করার এক প্রশংসনীয় লক্ষ্য ঠিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অর্থ দাঁড়ায় এখন থেকে আর মাত্র চার বছরের কম সময় হাতে আছে আমাদের। বলার অপেক্ষা রাখে না উদ্যোগ হিসেবে এটি চমৎকার। নাগরিক হিসেবে, আমি এ লক্ষ্য ও উদ্যোগের সঙ্গে একাত্ম। আমার বিবেচনায় লক্ষ্য নির্ধারণই প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ লক্ষ্য স্থির না থাকলে তো তা অর্জনের প্রচেষ্টাই থাকে না। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারণ করা লক্ষ্যের সাফাই যেমন একদিকে, অন্যদিকে আবার আছে কিছু বাস্তবতার নিরিখের প্রতিবন্ধকতাও। উদাহরণ দেওয়া যাক, খুচরা পর্যায়ে ওষুধ ব্যবসায় বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নাম লাজ ফার্মা। শুধু ওষুধ বিক্রি করে এত বড় ব্র্যান্ড ভ্যালু নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে আর কেউ করতে পারেনি। কিন্তু লাজ ফার্মায় যখন ওষুধ কিনতে যাবেন, দেখবেন তারা ডিজিটাল বা ক্যাশলেস পেমেন্টে আপনার ওপর একটা ‘জরিমানা’ বসিয়ে দিচ্ছে। জরিমানা শব্দটা আসলে রূপক অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিষয়টা হলো, আপনি যদি কাগুজে টাকায় ওষুধের বিল পরিশোধ করেন তো ৫ শতাংশ ছাড় পাবেন। আর যদি ডিজিটালি পেমেন্ট করতে যান তো ২ শতাংশ ছাড়।

লাজ ফার্মা এখানে একটি নামমাত্র। আরও অনেক ওষুধের দোকানেও একই ঘটনা দেখেছি। ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরেও একই অবস্থা। দিনকয়েক আগে নিজ জেলা শহরে এক ওষুধের দোকানে গিয়েও একই পরিস্থিতি। বাধ্য হয়ে পাশের এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে তারপর বিল পরিশোধ করলাম। পরিস্থিতি যা দাঁড়াল তা হলো, গ্রাহক চাইলেও তাকে ক্যাশলেস সেবা নিতে দেওয়া হবে না।

এটা শুধু ওষুধ খাতের কথা বলি তাহলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। যে কোনো গয়নার দোকানে যাবেন, একই কথা। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন কিনতে বা অন্য কোথাও শপিংয়ে যান—পজ মেশিন আছে, কিন্তু কার্ড নিতে চায় না। ঢাকার সবচেয়ে বড় শপিং মলটার কথাই যদি বলি, কার্ড দিলেই পাশের এটিএম বুথ দেখিয়ে দেয়। না হলে ছাড় মিলবে না অথবা অতিরিক্ত চার্জ দিতে হবে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদি এ লক্ষ্যও কি দীর্ঘমেয়াদের প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ছুটতে পারবে?

কয়েক মাস আগে এমন লক্ষ্যের কথা যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করছে তখন একই সঙ্গে তারা আরও একটি কাজও করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসের আশপাশের মতিঝিল অঞ্চলকে ক্যাশলেস এলাকা হিসেবে তৈরি করার বেশ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয় তখন। ফুটপাতের ফল বিক্রেতা থেকে টংয়ের চায়ের দোকান সব জায়গায় অভিন্ন বাংলা কিউআর কোড চালুও করা হয় সে অনুসারে। যাতে সহযেই যে কোনো পেমেন্ট অ্যাপ থেকে এই কিউআর কোড ব্যবহার করে পেমেন্ট করা যায়।

এই পর্যন্ত সব ঠিকই আছে। ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ক্যাশলেস লেনদেন নিশ্চিত করার হাত ধরে পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে শতভাগ লেনদেনকে ক্যাশলেস করার প্রক্রিয়াও এভাবে শুরু হবে বলে বিবেচনা করা হচ্ছিল, যা আসলে উন্নত বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশের মূল ভিত্তি হবে বলে মনে করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এরই মধ্যে খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে বাংলা কিউআর অজনপ্রিয় হয়ে গেছে। এর আগে যারা মিডিয়া কাভারের আলোয় এসেছিলেন, সেসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও আর এটি ব্যবহারই করছেন না। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কী ছিল, সেটা খোঁজ নেওয়া হয়নি। ফলে জানি না এখানে সমস্যা কী?

কিন্তু ওষুধের দোকান বা অন্য শপিং মলের আলো ঝলমলে দোকান যারা পজ মেশিন রেখেও ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রাহককে নিরুৎসাহিত করেন, তারা তো আসলে নিরুপায় হয়েই কাজটা করছেন। ঘটনাটা হলো, মূলত ডিজিটাল কারেন্সির এই লেনদেনের ওপর যে ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান থেকে পজ মেশিন নেওয়া হয়েছে, তাদের একটা ফি দিতে হয়। ফলে নিরুপায় না হলে তারা এদিকে এগোতেই চান না। অথবা কার্ড বা মোবাইল লেনদেনে বাধ্য হলে ওই বাড়তি খরচটা গ্রাহকের কাছ থেকেই পুষিয়ে নিতে চান। ব্যবসায়ীদের এখানে কোনো দোষ দেওয়ার নেই। কারণ ব্যবসার ধর্মই হলো মুনাফা নিশ্চিত করা। অন্যদিকে আবার ব্যাংক বা মোবাইল আর্থিক প্রতিষ্ঠানও কিন্তু চ্যারিটি করতে বসেনি। তারা একটা সেবা দিচ্ছে ফলে তাদেরও আয়ের জায়গা থাকতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তো এ ক্ষেত্রে চার্জের হারও জারি করে দিয়েছে। ফলে পুরো জিনিসটা হচ্ছে বৈধভাবেই।

এখন এটা স্পস্ট যে, বাড়তি খরচের খড়গ মাথার ওপর ঝুলিয়ে রেখে আর যাই-ই হোক, ক্যাশলেসের দিকে হাঁটা যাবে না; বরং চিন্তা করতে হবে ভিন্নভাবে। আর এখানে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। ক্যাশলেসের সুফল নিয়ে বাড়তি কিছু বলতে চাই না। যাই-ই বলব সব পুরোনো কাসুন্দির মতো হবে। শুধু একটা তথ্য দিতে চাই, ক্যাশলেস লেনদেন গ্রহণের সুবিধা ব্যবসায়ীর ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। তাহলেই সে এটি গ্রহণে ও প্রসারে আগ্রহী হবে।

এখানে একটা দরকারি উদাহরণ দিই। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা গবেষণা বলছে, শুধু ছাপা টাকার ব্যবস্থাপনা করতে রাষ্ট্রের বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়। এটি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের গবেষণা। জানি না এখন এ অঙ্কের হেরফের হচ্ছে কি না। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার যদি ডিজিটাল পেমেন্টকে উৎসাহিত করতে গিয়ে একটু খরচ করে তাহলে তো এই ৯ হাজার কোটি টাকার বড় অংশই বাঁচানো যায়। দ্বিতীয়ত, লেনদেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আনতে পারলেই তো টাকার গতি বাড়বে। একই টাকা দিনে বহুবার লেনদেন করা যাবে আর তাতে জাতীয় আয়ও বাড়বে অনেকগুণ। এসব উদাহরণ কিন্তু আমাদের আশপাশেই আছে।

এ পরিস্থিতিতে উন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে নিতে হলে ক্যাশলেস লেনদেনকে কীভাবে আরেকটু উৎসাহ দেওয়া যায়, সেটিই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এখানে নীতি সহায়তার কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি হয়তো এভাবেও ভাবা যায় যে, স্বল্পমেয়াদের সামান্য টাকার ক্ষতি দেখে পিছিয়ে না গিয়ে বরং সুদূরপ্রসারী লাভের দিকেই এগোতে হবে। নীতির বাধায় যেন ক্যাশলেস বা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন সুদূরপরাহত না হয়।

লেখক : মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, সাংবাদিক ও বিশ্লেষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025069713592529