নুসরাত-সংক্রান্তি ও নববর্ষ

হাসান ইমাম |

নুসরাতও আমাদের পুরনো বছরের ‘জীর্ণতা’! ওকে পেছনে ফেলেই আমরা পা রেখেছি নতুন বছরের আঙিনায়। এর আগেও আরো অনেক নুসরাতকে (রিশা, তনু ইত্যাদি) যেভাবে মুছে ফেলেছি আমাদের মনোজগত্ থেকে, সামাজিক মানচিত্র আর রাষ্ট্রিক পরিসর থেকে, নুসরাতও তেমনি ‘নাই’ হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়! একদিন তাকেও আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না— কী সামাজিক ডিসকোর্সে, কী গণমাধ্যমের বয়ানে, কী রাজনৈতিক ধারাভাষ্যে।

এই এক অদ্ভুত ভোজবাজির ব্যবস্থা কায়েম করতে পেরেছি আমরা সমাজে, সংসারে, রাষ্ট্রে। সবখানেই ব্যক্তিক ও সামষ্টিক দায়হীনতা সমানতালে ক্রিয়াশীল। এই অবস্থায় প্রাণবিক আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকা যায় কেবল; মানবিক জীবন জিয়ে না। নুসরাতরাও তাই বাঁচতে পারেন না। আর তাদের স্বজনেরা আমৃত্যু মনে বয়ে বেড়ান বেদনার বিহ্বলতা, শোকের কাতরতা, হতাশার অবসন্নতা আর ক্ষোভের তপ্ততা।

২. ভার্চুয়াল ক্রিয়া ও কর্মের রমরমা এই সময়ে ‘স্ক্রিন’ই যেন শেষ কথা! যা দেখার ডিজিটাল পর্দায় দেখি, যা বলার ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির ওয়ালে ওয়ালে বলি। এই দেখা, এই বলার মধ্যে আর কিছু থাকুক না-থাকুক, রীতিমতো চেষ্টা থাকে নিজেকে শো-আপের। নিজের দিকে অন্যের মনোযোগ টানার এই বেহদ ইন্তেজাম অন্য সবকিছু থেকে ‘দূরে’ ঠেলে দিচ্ছে আমাদের। তবে এই দূরত্ব ঘোচানোর একটা বিশেষ উদ্যোগও অবশ্য লক্ষ করা যায়— ভার্চুয়ালি তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়! ঘটনা ঘটতে না-ঘটতে তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত ও মন্তব্য পেশ হতে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। বলা চলে, রীতিমতো ভার্চুয়াল তরজা শুরু হয়ে যায়। অথচ বাস্তবের ঝড় মোকাবিলায় প্রয়োজন যখন বাস্তবিক প্রস্তুতি, সাহস, একতা; সেই প্রলয়ও যেন অন্তর্জাল দিয়ে বেঁধে ফেলতে আমরা প্রয়াসী! এই-ই যখন সময়ের ট্রেন্ড, তখন নুসরাতদের হারিয়ে যাওয়াই তো দস্তুর!

৩. এমনও নয়, মানুষ রাজপথে নামতে ভুলে গেছে, ভুলে গেছে কণ্ঠ ছাড়তে। তবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ন্যায্য দাবিদাওয়া, অধিকার আদায় ইত্যাদির প্রশ্নে যখন দরকার আরো আরো কিছু, তখন মানববন্ধন, বিবৃতি বা নিন্দাজ্ঞাপনে সীমাবদ্ধ থাকছে সবকিছু। কর্তব্যকে নাম-কা-ওয়াস্তে এই কর্মসূচিতে রূপান্তরের ফলও আমরা তাই পাচ্ছি হাতেনাতে। একে তো কানে মাফলার বাঁধা, তারওপর না-শোনার ভান করা সরকারের সাবেকি অভ্যাস। খোশামুদেরাও বলবেন—না, সরকার কান খুলে জনগণের কথা শুনতে উদগ্রীব। সুতরাং আমাদের বলার কথা, শোনানোর কথা অনেক থাকলেও শুধু ঠিকমতো কণ্ঠ না তুলতে পারায় রাষ্ট্রের অন্দরে তৈরি করতে পারছে না কোনো প্রতিধ্বনি। সে কারণে নুসরাতও কি তার পূর্বসূরিদের মতো অরবে হারিয়ে যাবে!

৪. নিজের প্রাণকে যিনি প্রতিবাদের ভাষা করলেন, জীবন দিয়ে লিখলেন প্রতিরোধের মহাকাব্য, তার কতটা পাঠোদ্ধার করলাম আমরা? আমাদের ব্যক্তিগত গণ্ডির ভেতর আঁচ না আসা পর্যন্ত সব অগ্নিকাণ্ডই ডিজিটাল মাধ্যমে রেকর্ড করার বিষয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করার জিনিস। নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়াও তো একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাই! তাই এর হলকা থেকে সুরক্ষিত আছি তো সব ঠিক আছে!

কিন্তু আগুনে না পুড়ে সোনা খাঁটি হওয়ার অন্য কোনো শর্টকাট বা ডিজিটাল পথ নেই। নুসরাতের শরীরের লাগানো আগুনে আমাদের মলিন চিন্তাভাবনার সব জঞ্জাল পুড়িয়ে ফেলার সময় তাই সমাগত। এই আগুনে পুড়ে যদি আমরা খাঁটি হতে না পারি খাদ মেশানোর কারবারিদেরই শেষতক জয় হবে, তাদের জমিন আরো পোক্ত হবে।

৫. ব্যবস্থায় খাদ থাকলে প্রতিকার নিখাদ হওয়ার কোনো উপায় নেই। ব্যবস্থা সংশোধনে প্রতিকারের খাদ দূর করা সম্ভব; কিন্তু ব্যবস্থাপকের ভাবনায় খাদ থাকলে? এই ব্যবস্থাপকের মনের ভেতরের খাদ কীভাবে দূর করা যায় তা-ই শিখিয়ে গেলেন নুসরাত। সপারিষদ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, ওসি মোয়াজ্জেম— এদের মনের খাদ, ভাবনার সংকীর্ণতা, চিন্তার গণ্ডিবন্ধতা, দৃষ্টির সীমাবন্ধতাকে পদাঘাত করে গেলেন নুসরাত। পুরুষ যা চাইবে তা-ই পাওয়ার ‘হকদার’, নারীর ভালো লাগার-মন্দ লাগার কিছু নেই— পুরুষালি সমাজের এই নামানুষি দাম্ভিক ভাবনাকে দুই পায়ে মাড়িয়ে থেঁতো করে গেলেন নুসরাত।

নুসরাতকে তাই এই সময়ের জোয়ান অব আর্ক, বাতিঘর, আরেক রোকেয়া, আলোকবর্তিকা, নির্ভয়া ইত্যাদি কোনো বিশেষণেই ‘আবদ্ধ’ করা যায় না। এই উপলব্ধি যদি আমাদের না আসে, কালের নিয়মে পুরনোটা গিয়ে নতুন বছর আসবে ঠিকই; কিন্তু জীর্ণতা দূর হবে না— না মনের, না সমাজের। মনের জীর্ণতা মুছে, চিন্তার দীনতা ঘুচিয়ে চোখ মেলার সময় এখনই। তাহলেই বুঝব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আমাদের কর্তব্য, কর্মসূচি নয়।

তাই শাব্দিক ও আত্মিক— দুই অর্থেই সার্থকতা পেতে পারে এবারের নববর্ষ, যদি আমরা নুসরাতের দেখানো পথে পা বাড়াতে পারি। মানবিকতার সেই পথের বাহন ন্যায়বিচার, গন্তব্য সুশাসন; আর পথচলার সাহসের নাম নুসরাত।

লেখক : সাংবাদিক

সূত্র: ইত্তেফাক

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
একাদশে ভর্তিতে কলেজ পছন্দে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে - dainik shiksha একাদশে ভর্তিতে কলেজ পছন্দে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: জুতার মালা শিক্ষককের - dainik shiksha ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: জুতার মালা শিক্ষককের ঢাকা বোর্ডের এসএসসি: অসন্তুষ্টদের খাতা চ্যালেঞ্জ ১ লাখ ৮০ হাজার - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডের এসএসসি: অসন্তুষ্টদের খাতা চ্যালেঞ্জ ১ লাখ ৮০ হাজার থমকে আছে শিক্ষক বদলি কার্যক্রম - dainik shiksha থমকে আছে শিক্ষক বদলি কার্যক্রম প্রশিক্ষক হতে শিক্ষকদের আবেদন আহ্বান - dainik shiksha প্রশিক্ষক হতে শিক্ষকদের আবেদন আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004662036895752