নোবেল পুরস্কারের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে আজ মঙ্গলবার বলো ১১টায় গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
গতকাল সোমবার প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম টাইমস ম্যাগাজিনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘রক্তচোষা’ হিসেবে অভিহিত করে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি লেখাটা পড়েছি। যেহেতু মামলা চলছে, আমি কোনো কমেন্ট করতে চাই না। কিন্তু একটা প্রশ্ন তাদেরকে করতে পারেন—আমেরিকা হোক, ইউরোপ হোক, যেকোনো দেশেই, কেউ যদি বছরের পর বছর ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা সেই সরকার নেয়। কেউ যদি ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, তাহলে কী ব্যবস্থাটা তারা নেয়। তার উত্তরটা কিন্তু এরা দেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় হলো শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে এত কথা হয়, কিন্তু সেই শ্রমিকদের ওয়েলফেয়ার ফান্ডের টাকা, কেউ ব্যবসা করলে ব্যবসার পাঁচ শতাংশ টাকা ওয়েলফেয়ার ফান্ডে দিতে হয়। এখন সেই শ্রমিকদের অর্থ যদি কেউ মেরে খায়, না দেয়, তাদের ন্যায্য পাওনাটা যদি না দেয়, তার বিরুদ্ধে তারা কী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে? ইউনূসের বিরুদ্ধে আমরা বা আমাদের সরকার লাগেনি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বরং আপনাদের (সাংবাদিকদের) মনে আছে একটা কথা, গ্রামীণ ব্যাংকটা তৈরি করেছিল জেনারেল এরশাদ সাহেবের আমলে। একজন এমডি খোঁজা হচ্ছিল, তখন ড. ইউনূসকে এনে সেই ব্যাংকের এমডি করা হয়। এই ব্যাংক কিন্তু তার নিজের করা না। সে সেখানে এমডি হিসেবে চাকরি করত। এমডি হিসেবে চাকরি করতেন এবং বেতন তুলতেন। আর গ্রামীণ ব্যাংকটা হচ্ছে সরকারের সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। ওই টাকা, বেতন সব কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকেই দেওয়া হতো। সরকারের কেউ বাইরে গেলে জিও নিয়ে যেতে হতো। সেই চাকরিরত অবস্থায় সেটাকে তিনি নিজে এমনভাবে প্রচার করেছেন যে এটা যেন তার নিজেরই করা।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওই ব্যাংকের আইনে ছিল যে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত একজন এমডি থাকতে পারে চাকরিতে। ৬০ বছরের ওপরেও আরও ১০ বছর তিনি আইন ভঙ্গ করেই ছিলেন। যখন বাংলাদেশ ব্যাংক এই জিনিসটা তার নজরে আনে এবং তাকে আমাদের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব (আবুল মাল আবদুল মুহিত) ও আমার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর সাহেব (ড. গওহর রিজভী) তাকে অনুরোধ করেছিলেন যে, ‘‘আপনার (ড. ইউনূস) তো বয়স হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ১০ বছর বেশি আপনি অবৈধভাবে এখানে আছেন। তো আপনি এখানে উপদেষ্টা হিসেবে থাকেন।’’ কিন্তু তিনি এমডি পদ ছাড়বেন না। এমডি পদে তাকে রাখতেই হবে।’
তিনি বলেন, ‘ড. ইউনূস কিন্তু আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে, অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বিরুদ্ধে দুইটা মামলা করেন। এ কথা তো সেই পত্রিকাওয়ালারা লেখেনি। দুইটা মামলা করেন এবং দুইটা মামলাই হেরে যায়। মামলা কিন্তু কখনো সরকার করেনি। এখনো তার বিরুদ্ধে যে মামলা, এটা কিন্তু সরকার করেনি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘গ্রামীণফোনের ব্যবসাটা আমিই তাকে দিয়েছিলাম। এটাও মনে রাখা উচিত। গ্রামীণ ফোনের ব্যবসাটা তাকে আমি দিয়েছিলাম কারণ গ্রামীণ ব্যাংক তার আমলে প্রায় কলাপস করে যাচ্ছিল। তখন আমার সরকার, আমি নিজে প্রথমে ১০০ কোটি টাকা, এরপরে ২০০ কোটি টাকা, তারপর আরও ১০০ কোটি টাকা, এই ৪০০ কোটি টাকা গ্রামীণ ব্যাংকে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে দিয়ে ব্যাংকটা চালু রাখতে তাকে সহায়তা করি। তখন তিনি প্রস্তাব দেন যে গ্রামীণ ফোনের ব্যবসাটা পেলে এর যে প্রফিটটা হবে সেটা গ্রামীণ ব্যাংকে জমা হবে এবং সেটা দিয়ে ব্যাংক চলবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত, আজ পর্যন্ত ওই গ্রামীণফোনের একটি টাকাও গ্রামীণ ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে কি না। দেওয়া কিন্তু হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘শুধু এখানেই না, গ্রামীণ ব্যাংকের বিদেশ থেকে অনেক সময় অনেক অনুদান এসেছে, তার কয়টা টাকা গ্রামীণ ব্যাংকে গেছে। প্রতিটা সময় ওইটা দিয়ে নতুন একটা ব্যবসা খুলে ব্যবসা করেছেন, কিন্তু কোনো ট্যাক্সই দেননি। এই যে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন, সেটা তো তিনি নিজেই প্রমাণ করেছেন। কারণ তার বিরুদ্ধে যখনই মামলা হয়েছে, এটা বিদেশে নিয়ম আছে, যখনই মামলা হয়েছে, তিনি কিছু টাকা শোধ দিয়ে বসে আছে। তো যখনই কিছু টাকা শোধ দিলেন, তখনই তো প্রমাণ হয়ে গেল যে তিনি ট্যাক্স ফাঁকি দেন। এমনকি ওই টেলিনর, গ্রামীণফোন সেখানে থেকেও কয়েক দফায় তার কাছ থেকে এভাবে টাকা আদায় করা হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আর লেবারদের যে ওয়েলফেয়ার ফান্ডের টাকা দেয়নি, ২০০৬ সাল থেকে একটি পয়সাও দেয়নি, তাই লেবাররা মামলা করেছে। মামলা কিন্তু সরকার করেনি। লেবাররা লেবার কোর্টে মামলা করেছে, সেই মামলায় সে শাস্তি পেয়েছেন, এখানে আমার কী দোষ।’
তিনি বলেন, ‘বরং আজকে তিনি যে উঠেছেন (সাফল্য পেয়েছেন), সেখানে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা তো আমি করেছিলাম। তার মাইক্রোক্রেডিট সামিট, মাইক্রোক্রেডিট ইন্টারন্যাশনালি খুব গ্রহণযোগ্য ছিল না। আমি কো-চেয়ার হিসেবে অংশগ্রহণ করি, জাতিসংঘে প্রস্তাব আনি এবং আমি সবাইকে বোঝাই, কারণ আমিও ভাবতাম এটা বুঝি খুব ভালো, এটা মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি পরে দেখলাম এটা দারিদ্র্যমুক্ত না, এটা দারিদ্র্য লালন-পালন করে। আর ওই গরিব মানুষগুলো দিনরাত কাজ করার পর উচ্চহারে সুদ দিতে হয়। প্রথম সুদ যখন দিতে পারে না, তখন আরেকটা লোন দিয়ে আগের লোন পূরণ করে সে আবার দ্বিগুণ সুদের হারে পড়ে, এভাবে করতে করতে পরে ৪০-৪৫ ভাগ সুদ দিতে হতো তাদেরকে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এমনকি যশোরের যে এলাকায় হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে যেসব পরিবারকে মাইক্রোক্রেডিট দিয়েছিল, সে পরিবারগুলো কোথায় এখন? খোঁজ করেন। জমিজমা সব বেচে দিয়ে ওখান থেকে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অনেকে আত্মহত্যা করেছে এই সুদের চাপে। আমি তাকে টাকা দিয়ে বলেছিলাম যে, এত সুদ না নিয়ে তারা যেন সহনশীল করে দেয়, যেন মানুষ সত্যিকার অর্থে দারিদ্র্য থেকে উঠে আসতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এতই যদি করে থাকে, তাহলে দারিদ্র্য বিমোচন হলো না কেন বাংলাদেশে? দারিদ্র্য বিমোচন করলাম তো আমি। আজকে ৪১ দশমিক ছয় ভাগ থেকে নামিয়ে আমি ১৮ দশমিক সাত ভাগে এনেছি মাত্র এই ১৫ বছরে। সেই ক্রেডিটও নেয়। সেটাও কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা লিখে ফেলে এটা গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, অমুক-সমুক করে ফেলেছে। আমার প্রশ্ন—আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে দারিদ্র্যের হার কত ছিল, শেখ হাসিনা আসার পর কত কমেছে, সেটা একটু হিসাব করে বলুক না। মাথাপিছু আয় কত ছিল, এখন কত বেড়েছে। গৃহ-ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা কত ছিল, আর এখন কত কমেছে। সেটা লিখুক।’
নোবেল পুরস্কারের প্রসঙ্গ তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আবার লিখেছে নোবেল প্রাইজের জন্য নাকি তার সঙ্গে আমার... আমার সঙ্গে কারো দ্বন্দ্ব নেই। আর আমি জীবনেও নোবেল প্রাইজের জন্য আমার কোনো আকাঙ্ক্ষাও নেই। কারণ আমার লবিস্ট রাখার টাকাও নেই, পয়সাও নেই, আর আমি কখনো এটা চাইনি।’
তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হওয়ার পরে শুধু আমার দেশে নয়, দেশে-বিদেশে অনেক বিদেশি, নোবেল লরিয়েট আমার জন্য লিখেছে। কই আমি তো কখনো তদবির করতে যাইনি, কারো কাছে বলতেও যাইনি। আমি তো কী পেলাম না পেলাম, ওটা নিয়ে আমি কখন ওগুলো আমার মাথার মধ্যেও নেই। এখন যিনি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করলেন, ব্যাংকের একজন এমডি, সে যখন একটা নোবেল প্রাইজ পায়, তার সঙ্গে আমি কনটেস্ট করতে যাব কেন?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি আমি করেছি। পৃথিবীতে যত শান্তি চুক্তি হয়েছে, খুঁজে বের করেন, শান্তি চুক্তি হয়েছে, কিন্তু কয়টা অস্ত্রধারী আত্মসমর্পণ করেছে? আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু শান্তি চুক্তিই করিনি, ১ হাজার ৮০০ জন তাদের অস্ত্রধারী ক্যাডার, তারা আমার কাছে অস্ত্র সারেন্ডার করেছে। আমি তাদের সবাইকে সামাজিক-আর্থিকভাবে পুনর্বাসন করেছি।’
তিনি বলেন, ‘৬৪ হাজার শরণার্থী ছিল ভারতে। আমি সবাইকে ফিরিয়ে এনেছি। তাদেরকে আমি প্রতিষ্ঠিত করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তির ফলে আজকে সেখানে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এর আগে সেখানে কী অবস্থা ছিল? শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে কতজন যেতে পারতেন? এখানে যদি বিদেশে কেউ আমার নামে প্রস্তাব দেয়, আমরা তো ছুটে যাইনি তাদের কাছে। আমার কাছে অনেকে আসছে, আমি বলেছি না আমার ওসব পুরস্কারের দরকার নাই। আর এই পুরস্কার আমি দেখেছি আন্তর্জাতিকভাবে যারা পায়, এখানে তাদের কতটুকু অবদান সেটা না, এখানে আলাদা একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। কাজেই ওর মধ্যে আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। আর বলে দিলো ওটা নিয়ে নাকি আমি উনাকে... মানে জেলাসি।’