কোরবানির বর্জ্য অপসারিত হবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, ঈদের পাঁচদিন আগে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের মুখ থেকে এমন আশ্বাস পেয়ে এক ধরনের স্বস্তিবোধ করছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বাসিন্দারা। অনেকেরই ধারণা ছিল, উত্তরের সঙ্গে প্রতিযোগিতার তাগিদ থেকে হলেও অন্তত এবার কোরবানির পর পাল্টাবে দক্ষিণের চিত্র। কিন্তু কিসের কী? কোরবানি ঈদ পেরিয়ে ছুটিও শেষ; অথচ প্রথম কর্মদিবসে অফিসের জন্য বের হতেই নাকে উৎকট দুর্গন্ধ। দিনের শুরুতেই বিরক্তি সঙ্গী করে কর্মস্থলে যাত্রা।
আশ্বাস দিয়ে ঈদ পালনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলেন মেয়র আর তার বড় আশ্বাস এখন বাতাসে বয়ে বেড়াচ্ছে পচা বর্জ্যের দুর্গন্ধের সঙ্গে মিশে। ঢাকা দক্ষিণের অলিতে-গলিতে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে কোরবানির পশুর বর্জ্য; সবচেয়ে বেশি করুণ দশা পুরান ঢাকার। কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনায় দুর্গন্ধের প্রকটতা এতটাই যে, নাক-মুখ চেপেও তার থেকে পরিত্রাণ মিলছে না বাসিন্দাদের।
এদিকে চোখে যেন টিনের চশমা ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সংশ্লিষ্টদের। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাস্তব চিত্র তুলে ধরার পরও তাদের দাবি, মেয়রের ঘোষণা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের আগেই তারা ঈদের দিনে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। পুরান ঢাকায় অনেকে ঈদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে পশু কোরবানি করেন। এমন দুই-একটি জায়গায় বর্জ্য জমেছে। বুধবার (১৯ জুন) রাতের মধ্যেই সেগুলো অপসারণ করবে ডিএসসিসি।
গত ১৭ জুন পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়েছে সারা দেশে। এর আগে ১২ জুন জাতীয় ঈদগাহ মাঠ পরিদর্শনে গিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের ঘোষণা দিয়েছিলেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তবে ঈদের আগেই তিনি সপরিবারে চলে যান যুক্তরাষ্ট্র। সেখান থেকেই অনলাইনে যুক্ত হয়ে পর্যবেক্ষণ করেন ৭৫ ওয়ার্ডের বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম।
ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে আগা সাদেক রোড, বংশাল রোড, আব্দুল হাদী লেন, চানখার পুল লেন, শিক্কাটুলী লেন, আবুল হাসনাত রোড এলাকা নিয়ে ডিএসসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড গঠিত।
বুধবার (১৯ জুন) ডিএসসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, এখানকার আগা সাদেক রোডে স্তূপ হয়ে আছে কোরবানির পশুর বর্জ্য। বৃষ্টির পানিতে বর্জ্য গড়িয়ে সড়কে ছড়াচ্ছে। চোখে পড়েনি ডিএসসিসির বর্জ্য অপসারণ বিভাগের কোনো কর্মীকেই। সড়কে চলার পথে নাক চেপে এলাকা পাড় হচ্ছেন বাসিন্দারা।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকার কোরবানির পশুর বর্জ্য এখনও অপসারণ হয়নি। আগা সাদেক রোডের এ বর্জ্য ঈদের প্রথম দিনের। এখন পচা বর্জ্যের দুর্গন্ধে দরজা-জানালা খুলতে পারছেন না আশপাশের ভবনের বাসিন্দারা।
তবে ডিএসসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আউয়াল হোসেন বলছেন, তার ওয়ার্ডে কোরবানির প্রথম দিনেই সব বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু অনেকেই কশাই না পেয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে পশু কোরবানি দিচ্ছেন।
একই রকম চিত্র দেখা গেছে ডিএসসিসির ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে। সিদ্দিক বাজার, হাজী ওসমান গনি রোড, নাজিরা বাজার লেন, কাজী আব্দুল হামিদ লেন, কাজী আলাউদ্দীন রোড, ফুলবাড়ীয়া পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন এলাকা নিয়ে গঠিত এ ওয়ার্ড। এখানকার কাজী আলাউদ্দীন রোড ও সিদ্দিক বাজারে কোরবানির পশুর বর্জ্য স্তূপ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে আশপাশের বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের সামনেও চলে গেছে বর্জ্যের অনেকাংশ।
কাজী আলা উদ্দীন রোডের বাসিন্দারা বলছেন, কাজী আলা উদ্দীন রোডের ৩৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের সামনে সারা বছর ধরেই বর্জ্য ফেলা হয়। এখন এ জায়গায় কোরবানির পশুর বর্জ্যের স্তূপ হয়ে আছে। অথচ মাত্র ২০০ মিটার দূরেই সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়। একই অবস্থা সিদ্দিক বাজারের। অথচ সিদ্দিক বাজারের সীমানা ঘেষেই নগর ভবন।
এছাড়া ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী জিয়া উদ্দীন রোড, সামসাবাদা লেন, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী জিয়া উদ্দীন রোড, জিন্দাবাহার, মৌলভী বাজার, বেগম বাজার, আর্মেনীয়াম স্ট্রিট, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের অরফানেজ রোড, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের পুষ্পরাজ সাহা রোড, জগন্নাথ সাহা রোড, ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের শনিরআখড়ায় সড়কেও কোরবানির বর্জ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
অথচ ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ বলছে, এবার কোরবানির হাট ও কোরবানির জবাই করা পশুর বর্জ্য অপসারণে ১০ হাজার ২৪৭ জন জনবল কাজ করেছে। আর কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণে ২৪ ঘণ্টার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হলেও প্রথম দিনে তা ১০ ঘন্টা ১৫ মিনিটে সম্পন্ন করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় দিনে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সময়ে ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৯টি ওয়ার্ডের বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। সব মিলে মঙ্গলবার (১৮ জুন) বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৫৫টি ট্রিপের মাধ্যমে ১৭ হাজার ৬৯২ মেট্রিক টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৮ জুন) বিকেলে ডিএসসিসির নগর ভবনের শীতলক্ষ্যা হলে স্থাপিত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত হয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন শেখ ফজলে নূর তাপস। এ সংবাদ সম্মেলনে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপনে উৎপন্ন বা সৃষ্ট বর্জ্য অপসারণে সামষ্টিক কার্যক্রম নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
এসময় নগরের বেশ কয়েকটি জায়গায় বর্জ্য পড়ে থাকা নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তাপস বলেন, কোরবানির পশু জবাই বিভিন্ন সময়ে হয়ে থাকে। একেকজন একেক সময়ে তা করে থাকে। সুতরাং আমরা পরিষ্কার করে আসার পরে অনেকেই জবাইকৃত সেসব পশুর বর্জ্য বিভিন্ন জায়গায় ফেলে রাখেন। এ ধরনের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা থাকে। এছাড়াও অনেকেই কোরবানির পশুর বর্জ্যের সঙ্গে হাটের বর্জ্য মিলিয়ে ফেলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনেও অনেকেই কোরবানি করে থাকেন। কিন্তু শতভাগ পরিষ্কার হওয়ার পরেই আমরা তা ঘোষণা দেই এবং প্রথম দিনের বর্জ্য বেশ কয়েকটি জায়গায় পড়ে ও তা অপসারণ করা হয়নি, সে বিষয়টি সঠিক নয়।
এদিকে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)। কথা রাখতে পেরেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। উত্তরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কোরবানির বর্জ্য চোখে পড়েনি কোথাও। সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ জানায়, মেয়র আতিকুল ইসলামের নির্দেশে ঈদের দিন দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে (৬ ঘণ্টায়) সব ওয়ার্ডে কোরবানির বর্জ্য অপসারণ করতে সক্ষম হয়েছে ডিএনসিসি। একইভাবে ঈদের দ্বিতীয় দিনের বর্জ্যও অপসারণ করা হয়েছে। বুধবার (১৯ জুন) ঈদের তৃতীয় দিনে তেমন কেউ পশু কোরবানি দেয়নি এ সিটি কর্পোরেশনে।