পরিচালনা কমিটি অর্থাৎ স্কুলের ক্ষেত্রে ১২ সদস্যবিশিষ্ট ‘ম্যানেজিং কমিটি’ আর কলেজের ক্ষেত্রে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট ‘গভর্নিং বডি’ নামে অভিহিত। সম্প্রতি মহলবিশেষ থেকে কমিটির সভাপতি ও সদস্য হওয়ার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর ও স্নাতক পাস হওয়ার মাপকাঠি নির্ধারণ করার দাবি উঠেছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এটি কোনো সমাধান নয়। এদেশের শতবর্ষী-অর্ধশতবর্ষী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠাতা বা সদস্যদের অধিকাংশেরই কোনো সনদ ছিলো না। তারা নিজেদের পকেটের টাকায়, পকেটের টাকায় না কুলোলে দ্বারে দ্বারে চেয়ে, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের অর্থ-বিত্ত ছিলো না; ছিলো শুধুমাত্র একটা সাদা মন আর সমাজকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার তীব্র বাসনা। প্রতিষ্ঠান থেকে দু’পয়সা রোজগার করা যায় এমন ভাবনা তাদের মাথায়ও আসেনি। আর এখন কমিটিতে ঢুকতে না পেরে অধ্যক্ষের মাথায় মানবমল ঢেলে দেয়া, সভাপতির অনৈতিক কাজ না করার জন্য প্রধান শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করার মতো ঘটনাও এদেশে আছে। কারণ, কমিটিতে ঢুকতে পারলে নানা উপায়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
পরিচালনা কমিটির ১৬টি দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতার কথা থাকলেও দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের পকেট ভারী করার উৎস হিসেবেই দেখছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম তদন্তের দায়িত্ব পালনকারী সংস্থা ‘পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ)’ কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘প্রতিষ্ঠানের ৯৫ ভাগ অনিয়ম ম্যানেজিং কমিটির কারণে হয়ে থাকে।’ এসবের ওপর শিক্ষা বিষয়ক সাহসী অনলাইন জাতীয় পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমসহ প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন ও খবর মূলত বেসরকারি শিক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ নির্ণয়ে প্যাথলজিক্যাল কিংবা বায়োকেমিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট। আজকের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিবর্ণ শিক্ষা চিত্রের জন্য মোটা দাগে পরিচালনা কমিটি দায়ী।
পরিচালনা কমিটি গঠনের বিদ্যমান আইনটিও ভীষণ ফাঁকফোকরে ভরা। পরিচালনা কমিটিতে বেশ কিছু ক্যাটাগরিতে (নাম উল্লেখ করলাম না) অশিক্ষিতদের ঢোকার অবাধ সুযোগ রয়েছে। অশিক্ষিত ও আধা শিক্ষিতদের কথা না হয় বাদই দিলাম; সংশ্লিষ্ট এলাকায় এমন কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি রয়েছেন, যারা মূলত সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এবং টাউট হিসেবে চিহ্নিত। ফলে কমিটিতে এমনসব ব্যক্তির দেখা মিলছে যাদের না আছে ভদ্রতা জ্ঞান, না আছে মনুষ্যত্ব, না আছে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য দুটি কথা বলার মতো সক্ষমতা। এদের সঙ্গে কর্মরত শিক্ষকদের একটা মানসিক দূরত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তৈরি হয়। আবার পরিচালনা কমিটি গঠনও একটি জটিল প্রক্রিয়া। কে আসবে, কাকে আনা হবে বা আনতে হবে তা নিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ভীষণ চাপের মুখে থাকতে হয। কমিটিতে ঢুকতে পারা এবং না পারাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের কারণে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই।
এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচলনা কমিটির হাত থেকে বাঁচাতে হবে। উল্লেখ্য এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, অঞ্চলভিত্তিক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অফিস, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন, শিক্ষা বোর্ড , পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, ব্যানবেইস, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়( ডিগ্রি স্তর) কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এইসব কর্তৃপক্ষের আদেশ, নির্দেশ ও শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এইসব কর্তৃপক্ষ একক কিংবা যৌথ সিদ্ধান্ত বলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি বা স্বীকৃতির নবায়ন হয় না। এমনকি এমপিও স্থগিত, কর্তন এবং বাতিলও করা হয়। এতসব কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের পরে ‘পরিচালনা কমিটি’ নামক বিষফোঁড়ার মতো বাড়তি কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি পাতারহাট আরসি কলেজ