পরিবর্তন আসছে পাঠ্যবইয়ের দরপত্রে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

পাঠ্যবইয়ের দরপত্রে পরিবর্তন আসছে। ছাপাখানা মালিকদের ‘জিম্মি দশা’ থেকে পরিত্রাণ পেতে এটি করা হচ্ছে। এতে সরকারের খরচও ‘সাশ্রয়’ হবে। এবার সরকারই দরপত্রের শর্তে কাগজের উজ্জ্বলতা ও জিএসএম কমিয়েছে। কাগজ উৎপাদনের অন্যতম মূল উপকরণ ‘পাল্প’ সঙ্কটের অজুহাত দেখিয়ে বেশির ভাগ ছাপাখানা মালিকের বিরুদ্ধে নিম্নমানের কাগজে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক ছাপার অভিযোগ রয়েছে। মঙ্গলবার (৭ মার্চ) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, কাগজ তৈরির কাঁচামাল ‘পাল্প’ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু ডলার ‘সঙ্কটের’ কারণে কাগজ মিল মালিকরা গত বছর পাল্প আমদানি করতে পারেনি বলে ছাপাখানা মালিকদের দাবি।

এছাড়াও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কার্যক্রম তিন মাস এগিয়ে আনা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে ইতোমধ্যে পাঠ্যপুস্তকের চাহিদাপত্র চাওয়া হয়েছে।

সরকারের শর্ত অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে কাগজের ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা (ব্রাইটনেস) এবং ৮০ শতাংশ জিএসএস (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) থাকার কথা। কিন্তু ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক ছাপায় বেশির ছাপাখানা মালিকই সরকার নির্ধারিত উজ্জ্বলতা ও জিএসএম দিতে পারেনি। ভার্জিন পাল্প ছাড়া কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা ও থিকনেস অর্থাৎ ৮০ শতাংশ জিএসএম ঠিকমত আসে না বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি।

নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, ‘ভার্জিন পাল্প’ আমদানি বন্ধ থাকায় গতবছর ভালোমানের কাগজ উৎপাদন সম্ভব হয়নি। দেশে গত বছর মাত্র দুটি মিলে ৮০ জিএসএমের কাগজ উৎপাদন হয়েছে। বাকি সব মিলই নিউজপ্রিন্টের মতো ৭০ জিএসএমের কাগজ উৎপাদন করছে। এ কারণে বইয়ের মান ‘খুব খারাপ’ হয়েছে তার দাবি।

দরপত্রের শর্তে ‘উজ্জ্বলতা’ ও ‘জিএসএম’ কমিয়ে আনলে খুব একটা কাজে দেবে না মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘ভার্জিন পাল্প আমদানির সুযোগ রাখতেই হবে। পাল্প ছাড়া কাগজে ৮০ শতাংশ উজ্জ্বলতাও আসবে না। তবে বইয়ের মান ভালো করতে হলে যেসব পেপার মিল ভালোমানের কাগজ উৎপাদন করে সেগুলোকে এনসিটিবির অ্যানলিস্টেট করতে হবে। মিল মালিকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কাগজের দামও এনসিটিবিকে ঠিক করে দিতে হবে।’

কাগজ মিল মালিক এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা ও ৮০ শতাংশ জিএসএমের এক টন কাগজের মূল্য প্রায় এক লাখ দশ হাজার টাকার মতো ছিল। কিন্তু উজ্জ্বলতা ৮০ শতাংশ এবং জিএসএম কিছুটা কম হলে প্রতি টন কাগজের মূল্য অন্তত ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা কম হয়।

এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় প্রতি বছরই পাঠ্যবইয়ের ছাপার মান নিয়ে বিতর্ক উঠে। ছাপাখানা মালিকরা শর্ত উপেক্ষা করে ‘নিম্নমানের’ কাগজে বই ছাপে। কাগজে যথাযথ ‘উজ্জ্বলতা’ ও ‘জিএসএম’ থাকে না। বছরের শেষ প্রান্তে এসে সরকার এসব বই গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

এ কারণে এবার সরকার কাগজের ‘উজ্জ্বলতা’ ও ‘জিএসএম’ কিছুটা কমিয়ে দরপত্র আহ্বান করেছে। এতে বই ছাপাতে সরকারের ব্যয় কমে আসবে। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে ‘ভার্জিন পাল্প’ও আমদানির প্রয়োজন হবে না এনসিটিবি কর্মকর্তারা মনে করছেন।

দরপত্রের শর্ত শিথিলের ইঙ্গিত দিয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা আগামী (২০২৪) শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ের দরপত্রে সামান্য পরিবর্তন আনছি। এবার সব পাঠ্যপুস্তকের ব্রাইটনেস ৮০ থেকে ৮২ রাখতে হবে। আর থিকনেস ৮০ জিএসএম রাখার মত দিয়েছেন ডিপিই (প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর)। এই শর্তের কাগজ দেশেই উৎপাদন হয়। বিদেশ থেকে কোন কিছু আমদানির প্রয়োজন হবে না।’

তিন মাসে বই ছাপা শেষ করার উদ্যোগ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপা করার উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি। কারণ চলতি বছরের শেষ নাগাদ কিংবা আগামী বছরের শুরুতেই সংসদ নির্বাচন। এর আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরগরম থাকতে পারে। ছাপাখানাগুলোও নানা রকম প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে পারেন। শ্রমিক সঙ্কটও হতে পারে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগামী শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিকের বই ছাপা ও সরবরাহ শেষ করতে চাই। আর অক্টোবরের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের ছাপা ও সরবরাহ শেষ করতে চাই। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিকের দরপত্র আহ্বান শুরু হয়েছে।’

বছরের শেষ দিকে এসে বই ছাপা কাজে প্রেস মালিকদের (ছাপাখানা মালিক) ‘জিম্মি’ করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়- জানিয়ে তিনি বলেন, এসব প্রেস মালিকের বই ছাপতে মেশিনের সক্ষমতার যতটুকু না অভাব, তার চেয়ে বড় অভাব তাদের ব্যবস্থাপনার। এ কারণে নতুন বছরের বই ছাপাকাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদের সভাপতিত্বে গত ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের জন্য অ্যানুয়াল প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান (এপিপি) ও টাইম বাউন্ড অ্যাকশন প্ল্যান (টিএপি) অনুমোদন হয়। সভায় ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক ছাপা শেষ করার সিন্ধান্ত হয়।

ওই সভায় ডিপিই মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, চলতি বছর জাতীয় নির্বাচনের বছর; এ কারণে বছরের শেষ দিকে শ্রমিক সংকট দেখা দিতে পারে। তাছাড়া কাগজ উৎপাদনকারী এবং মুদ্রণ কারখানা একসঙ্গে নির্বাচনী সামগ্রী ও পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম নাও হতে পারে। সেই বিবেচনায় তিনি আগামী শিক্ষা বছরের জন্য পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ কার্যক্রম এগিয়ে আনার পক্ষে মত দেন।

সভায় গণশিক্ষা সচিব বলেন, চলতি শিক্ষাবর্ষের অভিজ্ঞতা ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের সময়সূচি এগিয়ে আনা প্রয়োজন। কোন মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে অপারগ হলে পুনঃদরপত্র আহ্বানের যথেষ্ট সুযোগ রাখা এবং প্রয়োজনে বিজি প্রেসের মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

চার ধাপে প্রাথমিকের দরপত্র

চার ধাপে প্রাথমিকের বই ছাপার দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করা হচ্ছে জানিয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির জন্য প্রথম ধাপ; দ্বিতীয় ধাপে প্রাক-প্রাথমিক; তৃতীয় ধাপে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং চতুর্থ ধাপে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।’

‘রেসপনসিভ’ দরদাতা পাওয়া না গেলে পরবর্তী তিন কার্যদিবসের মধ্যে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রাথমিকের প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর বই ছাপার দরপত্র (টেন্ডার) আহ্বান করা হয়েছে। ১৫ মার্চের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণীর বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এরপর অন্য শ্রেণীর বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে।’

বইয়ের চাহিদা পাঠানোর নির্দেশ

২০২৪ শিক্ষাবর্ষে কত সংখ্যক বই ছাপাতে হবে সেই তালিকা পাঠাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দিয়েছে এনসিটিবি। নির্ধারিত সার্ভারে (www.textbook.gov.bd/brs) লগ ইন করে চাহিদা পাঠাতে হবে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে।

৭ মার্চের মধ্যে জেলা ও উপজেলা বা থানা শিক্ষা অফিস থেকে চাহিদা দাখিল করতে হবে। এরপর ৯ মার্চ জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে চাহিদা অনুমোদন দিতে হবে। আর ১২ মার্চ মাউশির আঞ্চলিক উপ-পরিচালকরা চাহিদা অনুমোদন দেবেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039961338043213