পরিবারের অবদান অপরিসীম

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ |

আজ বুধবার আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়। যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার মানসিকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘের মতে, দিনটি পরিবার সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর এবং পরিবারগুলোকে প্রভাবিত সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং জনসংখ্যার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান বাড়ানোর একটি সুযোগ সৃষ্টি করে। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। পরিবার আত্মীক সম্পর্কের সূতিকাগার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গড়ে ওঠে স্নেহ মমতা, ভালোবাসা সৌহার্দ এবং পারস্পারিক সম্পর্কের বন্ধন।

প্রাচীন কাল থেকে যে যৌথ পরিবারে চিত্র সারাবাংলা জুড়ে ছিলো এখন তা অনেকটাই ম্লান। শহুরে জীবনে অনেক আগেই বিলীন হয়েছে যৌথ পরিবারের চিত্র। আগে গ্রামে কিছু যৌথ পরিবার দেখা গেলেও এখন তাও নেই। বংশ মর্যাদা এমনকি ঐতিহ্যের পরিবারেও বিলীন একত্রে বাস করার ইতিহাস। পরিবার মানেই হচ্ছে মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদা, দাদী সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসবাস। আমাদের সমাজব্যবস্থায় পরিবারের এই ধারণা প্রচলিত অতীত থেকেই। কিন্তু দিন যতোই যাচ্ছে, আমরা যেনো ততোই এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছি। যেন ক্রমেই ‘স্বামী-স্ত্রী-সন্তানে’ই সীমাবদ্ধ করে ফেলছি আমরা পরিবারকে। সেখানে মা-বাবা কিংবা দাদা-দাদীর কোনো স্থান নেই। মা-বাবাকে হয়তো গ্রামের বাড়িতে কাটাতে হচ্ছে নিঃসঙ্গ-অসহায় জীবন। আবার অনেক মা-বাবার ঠিকানা হচ্ছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে একান্নবর্তী কিংবা যৌথ পরিবারের ধারণা যেনো এখন ‘সেকেলে’ হয়ে গেছে। বিশেষ করে, শহুরে জীবন ব্যবস্থায় এই বিষয়টি চরম আকার ধারণ করেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের সমাজে প্রচলিত যৌথ পরিবারে পারস্পরিক সম্প্রীতি গভীর হয়, অটুট থাকে। অসুখ বিসুখসহ নানা সমস্যায় একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। 

এতে অনেক বড় সমস্যাও সমাধান হয়ে যায় অতি সহজে। সময়ের তাগিদে যৌথ পরিবার কিংবা পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার বিষয়টি যখন এই সমাজে ক্রমান্বয়ে গুরুত্বহীন হয়ে উঠছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আজকের এই আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। রক্তের বন্ধন মানেই পারিবারিক বন্ধন। পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে অকৃত্রিম সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তা অটুট রাখা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের চিরায়ত সমাজ ব্যবস্থায় সুন্দর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, সুন্দর পারিবারিক বন্ধন। পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধুর মতো হলে পারিবারিক নানা জটিল সমস্যা ও মোকাবিলা করা যায়। সবার এগিয়ে চলার পথ হয় মসৃণ।

মানবজীবনে প্রত্যেক মানুষের জন্য পারিবারিক শিক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর এগুলো আয়ত্ত করতে পরিবার-ই সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। নানাবিধ চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। ভদ্রতা, নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা, কৃতজ্ঞতাবোধ শেখা,বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন, কনিষ্ঠদের স্নেহ-আদর করা, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, পরোপকারিতার মানসিকতা গড়ে তোলা, উদার মানসিকতাবোধ জাগ্রত করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যতটা না অর্জন করা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিবার থেকে অর্জন করা যায়।

পরিবারের সদস্যদের সুন্দর ও নিরাপদ জীবন গড়ে তোলার জন্য পরিবার বহুবিধ কাজ করে। পরিবার সাধারণত যেসব কার্য সম্পাদন করে, সেগুলো নিম্নরূপ-

জৈবিক কাজ : আমাদের মা-বাবা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি এবং তাদের দ্বারা লালিত পালিত হচ্ছি। অতএব, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন করা পরিবারের অন্যতম কাজ। পরিবারের এই ধরনের কাজকে জৈবিক কাজ বলা হয়।
 শিক্ষামূলক কাজ:  আমাদের মধ্যে অনেকে বিদ্যালয় যাওয়ার পূর্বেই পরিবারের বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হই। তাছাড়া মা-বাবা-ভাই-বোন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পারস্পারিক সহায়তায় সততা, শিষ্টাচার, উদারতা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলি শিক্ষালাভের প্রথম সুযোগ পরিবারেই সৃষ্টি হয়। এগুলো পরিবারের শিক্ষামূলক কাজ। আর পরিবারে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বলে পরিবারের শ্বাশত বিদ্যালয় বা জীবনের প্রথম পাঠশালা বলা হয়।

অর্থনৈতিক কাজ: পরিবারের সদস্যদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি চাহিদা পূরণের দায়িত্ব পরিবারের।পরিবারের সদস্যরা বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে এসব চাহিদা মিটিয়ে থাকে। পরিবারকে কেন্দ্র করে কুটির শিল্প, মৎস্য চাষ, কৃষি কাজ, পশুপালন ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাজ সম্পাদিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমে গিয়েছে। তবে আজও পরিবার আমাদের সকল প্রকার অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করছে।
একটি আদর্শ পরিবারে অন্যতম কার্যাবলী হলো পরিবারের সবাই মিলেমিশে একত্রে বাস করা। আর এ কাজটাই একটি আদর্শ পরিবার থাকে। পরিবারের সবাই একটি নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা মধ্যে বাস করেন। তারা বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজ হতে নিজেদের বিরত রাখেন এবং শান্তিতে বসবাস করেন।

পরিবারের কারো বিপদে পরিবারের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ তাকে মানসিকভাবে সাহায্য করেন। ফলে তিনি তার বিপদ দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারেন। একটি আদর্শ পরিবারের লোকজন সর্বদা একে অন্যের প্রতি সহযোগী মনোভাব প্রকাশ করে। কেউ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্যের কমতি থাকে না।

পরিবারের কেউ ভুল কাজ করে থাকলে তাকে শাস্তি না দিয়ে বুঝানোর মাধ্যমে ক্ষমা করে দেয়ার মনোভাব একটি আদর্শ পরিবার এর অন্যতম কার্যাবলী।

এই আধুনিক যুগে সবাই এখন যন্ত্র হয়ে গেছে কিন্তু একটি আদর্শ পরিবারের সব সদস্য একে অন্যকে যথেষ্ট পরিমাণ সময় দেন।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য আছে, আছে নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি। এইসব কিছুকেই আমাদের ধারণ করে সামনে এগোতে হবে। তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন কিছু সংবিধান আছে তেমনি পারিবারিক সংবিধানও থাকা দরকার। যেমন পরিবারের সবার সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলা, সাংসারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিথ্যে না বলা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফেরা, নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করা, মিথ্যেকে ঘৃণা করা এবং মানবিক মূল্যবোধগুলোর চর্চার মাধ্যমে অন্তরকে বিকশিত করা। আমাদের জাতিগত একটি বৈশিষ্ট্য আছে, আছে নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি। এই সবকিছুকেই আমাদের ধারণ করে সামনে এগুতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, অন্যের কাছ থেকে ধার করা কোনো কিছুতেই গৌরব নেই। বরং তা আমাদের জন্য অপমান। সর্বোপরি, পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে বলেই আমাদের সামাজিক নানা সমস্যা দিন দিন বেড়ে চলছে। বাড়ছে অস্থিরতা। ধর্মীয় বিধানেও রক্তের সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার ওপর তাগিদ দেয়া হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার সমাজের ভিত্তিমূল। হিন্দু ধর্ম মতে, পরিবার হচ্ছে একটি মন্দিরের মতো, যেখানে দেবতা স্বরূপ বাবা-মা বাস করে। তাই আন্তর্জাতিক পরিবার দিবসে বিশ্বের প্রতিটি পরিবারের বন্ধন দৃঢ় হোক এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য  অক্ষুন্ন থাকুক। প্রতিটি পরিবারে বিরাজ করুণ অনাবিল সুখ শান্তি।'

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর - dainik shiksha শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী - dainik shiksha আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে - dainik shiksha জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ - dainik shiksha বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য - dainik shiksha এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা - dainik shiksha অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর - dainik shiksha ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন - dainik shiksha বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী - dainik shiksha একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026888847351074