মাদারীপুরের শিবচরে ভান্ডারীকান্দি আছালত মেমোরিয়াল (এএম) উচ্চ বিদ্যালয়ে কোনো নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়া, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও কর্মরত শিক্ষকদের না জানিয়ে—ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে তিন শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় নিয়োগপ্রাপ্ত তিন শিক্ষকসহ প্রধান শিক্ষককে তিন মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সভায় তাঁদের বরখাস্ত করা হয়।
বরখাস্ত করা শিক্ষকরা হলেন প্রধান শিক্ষক মো. এনামুল হক হাওলাদার, সহকারী শিক্ষক যুধিষ্ঠির কুমার মণ্ডল, সহকারী শিক্ষক শিশির বিশ্বাস ও সহকারী শিক্ষক সুমিতা রানী বৈদ্য।
এই ঘটনায় ইতোমধ্যে বিদ্যালয় ব্যবস্থা কমিটির সভাপতি হাবিবুর রহমান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাসহ জেলা প্রশাসন ও দুর্নীতি কমন কমিশন (দুদক) বরাবর অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে মহামারী করোনার সময় সভাপতির অসুস্থতায় তথ্য গোপন করে তাঁর স্বাক্ষর নেন প্রধান শিক্ষক। পরে তিনি গত ১০ মে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে নিয়োগ হয়েছে মর্মে কাগজপত্র তৈরি করেন। একটি জালিয়াতচক্রের মাধ্যমে ভুয়া শাখা দেখিয়ে নিয়োগ দেন। পরে তাঁরা ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাস থেকে এমপিওভুক্ত হয়ে সরকারি বেতন ভোগ করে আসছেন। এদিকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে মন্ত্রণালয়ের অডিট রিপোর্টে নিয়োগপ্রাপ্ত তিনজনের কোনো তথ্য নেই। পরে বিষয়টি বিদ্যালয়ের সভাপতির দৃষ্টিগোচরে হলে তিনি প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলে প্রধান শিক্ষক তাঁকে অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা সূত্রে জানা যায়, যখন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন পত্রিকায় কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। নিয়োগের সময় নয়জন দরখাস্তকারী আবেদন করেছে বললেও কোনো দরখাস্ত পাওয়া যায়নি। নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়া এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও কর্মরত শিক্ষকদের না জানিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তাঁদের গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তিন মাসের জন্য বরখাস্ত করা হয়।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে সহকারী শিক্ষক সুমিতা রানী বলেন, ‘স্যার তখন আমাদের বলেছেন বিধি অনুযায়ী আপনাদের নিয়োগ হবে।’
নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছিল কি না, এ ব্যাপারে সহকারী শিক্ষক সুমিতা রানীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, পরীক্ষা হয়েছিল। তবে পরীক্ষা কোথায় হয়েছে? তা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি তার উত্তর দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে সহকারী শিক্ষক যুধিষ্ঠির কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমার বাড়ি ফরিদপুরের কামারখালি। আসলে নিয়োগের বিষয়ে আমি কিছু জানতাম না, আমার এক বড় ভাই ছিল। তিনি যোগাযোগ করে দিলেন। তারপর নিয়োগপত্র, যোগদানপত্র পেলাম। আমার ওই ভাইয়ের নাম সুজন। তিনি বললেন আগে নিয়োগ দেওয়া ছিল। পেপার কাটিং-টাটিং সব আছে। তোমার বিল-মিল সব করে দেওয়া যাবে। পরে আমি বাড়ি ছিলাম। বিল হইছে পরে আমি স্যারকে ফোন দিয়ে স্কুলে আসি।’
নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বিষয়ে জানতে চাইলে যুধিষ্ঠির কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিনি। আমাকে বলেছিলেন নিয়োগ আগে দেওয়া ছিল। তোমার কমার্সের স্যার নেই, বিল হয়ে যাবে। আমাকে যিনি যোগাযোগ করে দিয়েছেন, তিনি আমার বিল করার জন্য চার লাখ টাকা নিয়েছেন। সুজন ভাই আমার কাছ থেকে ওই টাকা নিয়েছেন। তারা সবাই টাকা পেয়েছেন। আর টাকা না দিলে তো বিল করে দেয়নি।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. এনামুল হক হাওলাদার বলেন, শিক্ষক নিয়োগটি যেভাবে হওয়ার হইছে। এ বিষয় নিয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি আমাকেসহ আরো তিনজন শিক্ষককে বরখাস্ত করেছে। তা ছাড়া সভাপতির সঙ্গে আমার একটু খারাপ সম্পর্ক ছিল। এই কারণেই ঝামেলাটা হইছে। বিষয়টি শিগগিরই সমাধান হয়ে যাবে।’
অর্থ লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক তা অস্বীকার করেন।
বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁদের অবৈধ হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই অপরাধ সংঘটনের ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করার মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হাবিবুল্লাহ খান বলেন, ‘তদন্ত করে দেখব যে তাঁরা ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে যোগদান করেছেন নাকি ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে যোগদান করছেন। সেটা তাঁদের নথিপত্র দেখলেই বোঝা যাবে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের নিয়োগে তারা ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে যোগদান করেছেন, নাকি ২০১৫ সাল থেকেই কাজ করছেন সেটা দেখে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেব।’
যদি অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে বিভাগীয় ব্যবস্থা কী হতে পারে—জানতে চাইলে শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা আমাদের ডিপার্টমেন্ট দেখবে।’