'পরীক্ষার অশুভ চক্র থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনা উচিত'

মুহম্মদ জাফর ইকবাল |

আজকাল ভিডিও লিংক পাঠানো একধরনের ফ্যাশন। সে কারণে মাঝে মাঝেই নানা ধরনের ভিডিও দেখতে হয়। বেশির ভাগ ভিডিও একধরনের হাস্যকৌতুক। তবে হঠাৎ হঠাৎ এক-দুটি সিরিয়াস ভিডিও চলে আসে। কিছুদিন আগে সে রকম দুটি ভিডিও দেখেছি। একটিতে একজন পাকিস্তানি মহিলা মাথা চাপড়ে হাহুতাশ করছেন। বাংলাদেশ কীভাবে সাঁই সাঁই করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আর পাকিস্তান কীভাবে হুড় হুড় করে অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে, সেটি নিয়ে তাঁর হাহাকার। এই ভিডিওটি দেখে আমি বিশেষ অবাক হইনি। কারণ, আমি বহুদিন থেকেই জানি পাকিস্তান নামক দেশটি তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে শুরু করেছে। (আমার অবশ্য একটা নিজস্ব ভিন্ন হিসাব আছে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা নানা ধরনের অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়। যখনই ফলাফল বের হয়, আমি আশপাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করি। আমরা প্রায়নিয়মিতভাবে আশপাশের দেশ থেকে ভালো করি, আজকাল তুলনা করার জন্যও পাকিস্তানের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই অনুমান করতে পারি পাকিস্তানের অবস্থা ভালো নয়, মোটামুটি গুরুতর, তাদের জিডিপিও আমাদের অর্ধেক!)

তবে দ্বিতীয় ভিডিওটি দেখে আমি অবাক হয়েছি। সেখানে বলা হয়েছে আমাদের জিডিপি ভারতের থেকে বেশি। সোজা বাংলায় অনুবাদ করলে সেটা বোঝায় আমরা আজকাল ভারত থেকে বড়লোক (এটি আমার নিজের কথা নয়, দেশি–বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কথা)! আমাদের বামপন্থী অর্থনীতিবিদেরা অবশ্য প্রাণপণে আমাদের বুঝিয়ে যাচ্ছেন এগুলো আসলে ‘ভুয়া’ এবং এই ‘তথাকথিত উন্নতি’ আসলে একধরনের সর্বনাশের লক্ষণ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি যেহেতু অর্থনীতি বুঝি না, তাই বড়লোক হয়ে যাওয়ার ছেলেমানুষি আনন্দের হাসিটা লুকাতে পারি না।

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

কিন্তু তারপরেই আমার মাথায় নতুন একটা চিন্তা এসে বাসা বাঁধে। আমরা যদি ভারত থেকে বড়লোক হয়ে থাকি তাহলে আমাদের দেশে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছিও একটি বিশ্ববিদ্যালয় নেই কেন? হলিউডে একটা সিনেমা তৈরি করতে যে পরিমাণ টাকা লাগে, তার থেকে কম টাকা খরচ করে ভারত কেমন করে মহাকাশে মহাকাশযান পাঠায়? তারা কেমন করে মঙ্গল গ্রহে অভিযান করে। আর কেন আমাদের ইলন মাস্ক থেকে রকেট কিনে সেটাতে করে বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহ পাঠাতে হয়? যখন করোনাভাইরাস সারা পৃথিবী তছনছ করে দিচ্ছে, তখন ভারত কেমন করে করোনার টিকা তৈরি করে সারা পৃথিবীকে টিকা দিতে পারে, আমরা কেন পারি না? আমাদের কেন টাকা পরিশোধ করেও টিকা না পেয়ে মাথা চাপড়াতে হয়? ভারতে কেমন করে এতগুলো অসাধারণ ল্যাবরেটরি, সেখানে কেমন করে এত বড় বড় বিজ্ঞানী, আমাদের দেশে কেন বড় কোনো ল্যাবরেটরি নেই, এখানে কেন নিয়মিতভাবে বিশ্বমানের গবেষণা হয় না? ভারতে বিজ্ঞানীরা কেন বিদেশ থেকে লেখাপড়া, গবেষণা করে তাঁদের দেশে ফিরে আসেন?

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন

মাদের মেধাবী ছেলেমেয়েরা কেন কেউ ফিরে আসে না? ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের থেকে দরিদ্র হয়েও কেমন করে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে আকাশছোঁয়া আর আমরা কেন ছেলেমানুষি মোবাইলের অ্যাপস ছাড়া আর কিছু বানাতে পারি না?

যখন এসব চিন্তা করি তখন বুঝতে পারি যে শুধু অর্থনীতিতে উন্নতি করলে হয় না, একই সঙ্গে লেখাপড়া আর জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চাতেও উন্নতি করতে হয়। যদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি তাহলে বুঝতে পারব আমরা আসলে কখনোই ঠিকভাবে আমাদের লেখাপড়ার দিকে নজর দিইনি। আমাদের শুধু যে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় নেই তা নয়, আমাদের স্কুল–কলেজের অবস্থা মোটেও ভালো নয়। এখন ছেলেমেয়েরা শুধু পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার জন্য লেখাপড়া করে। সে জন্য তারা কোচিং সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি করে, গাইড বই মুখস্থ করে। প্রায় সব স্কুল–কলেজের শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পড়িয়ে প্রাইভেট পড়ান।

এই দেশের সব হর্তাকর্তা বিধাতারা সেগুলো দেখেও না দেখার ভান করেন, মেনেই নিয়েছেন এটা এখন এই দেশের কালচার। দেশের সবচেয়ে হতদরিদ্র মানুষেরাও না খেয়ে না দেয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ানোর জন্য টাকা আলাদা করে রাখেন। তাঁরা জানেনও না যে লেখাপড়া করতে প্রাইভেট পড়তে হয় না, কোচিং করতে হয় না, শুধু স্কুলে গেলেই হয়। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য আলাদা কোচিং হয়, ‘মেডিকেল কোচিং’, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং’ নামে আলাদা কোচিং আবিষ্কার হয়েছে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা ঢাকা শহরে এসে মেসে থেকে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করে। কোচিং সেন্টারগুলোর সে কী রমরমা ব্যবসা! (আমার খুব কৌতূহল জানার জন্য তারা বছরে কত টাকা কামাই করে আর কত টাকা ইনকাম ট্যাক্স দেয়।) কোচিং সেন্টারের লোকজনের জীবনে অনেক আনন্দ থাকতে পারে। কিন্তু এই দেশের ছেলেমেয়েদের থেকে নিরানন্দ জীবন পৃথিবীর আর কোনো দেশের ছেলেমেয়েদের আছে কি না, জানি না। চোখের সামনে এগুলো হচ্ছে দেখেও আমরা থামানোর চেষ্টা করি না। এসব দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে আমরা আসলে লেখাপড়ার দিকে নজর দিইনি।

কেউ কেউ নিশ্চয় আমার এই কঠিন কথাগুলো শুনে মন খারাপ করবেন। অনেকেই হয়তো আমরা লেখাপড়ার দিকে নজর দিইনি কথাটা মানতে চাইবেন না। অন্য সবকিছু ছেড়ে তাদের আমি শুধু একবার আমাদের দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কর্মকাণ্ডের কথা মনে করিয়ে দিতে পারি। খবরের কাগজে পড়ি আর লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়। সবাই কি জানেন খবরের কাগজে শুধু সেই ঘটনাগুলোর কথা আসে, যেগুলোর তথ্য–প্রমাণ আছে। এর বাইরে অসংখ্য আরও ভয়ংকর ঘটনার কথা আছে, যেগুলো বাইরের মানুষেরা জানে না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব সময় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অর্থাৎ দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাবিদদের একজন। কাজেই আমাদের ধরে নেওয়ার কথা তিনি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। কিন্তু তাঁদের কারও কারও কর্মকাণ্ড দেখে তাঁর প্রতি কোনো মানুষের কী বিন্দুমাত্র সম্মান থাকা সম্ভব? শুধু কি অনৈতিক কাজ? তাঁদের কর্মকাণ্ড কি সরাসরি অপরাধের মাঝে পড়ে না? দেশের একজন সাধারণ নাগরিক সেই কাজ করলে তাকে জীবনের বড় অংশ জেলখানায় কাটাতে হতো। কিন্তু আমাদের উপাচার্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁদের কখনো কোনো শাস্তি পেতে হয় না। (যখনই এ রকম কিছু দেখি তখন আমার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাইকেল চোরের কথা মনে পড়ে। ধরা পড়ার পর তাঁকে সে কী বেদম মার, অনেক কষ্টে তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলো। অথচ এর থেকে আরও হাজার গুণ বড় অপরাধ করার পরেও উপাচার্যদের কিছু হয় না। আমি নিজের কানে একজন উপাচার্যকে তাঁর আগের উপাচার্য সম্পর্কে বলতে শুনেছি যে তিনি নাকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন।)

দুর্নীতির কথা শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, সমাজের অন্য যেকোনো মানুষের দুর্নীতির কথা শুনে হজম করা সম্ভব, কিন্তু একজন উপাচার্যের দুর্নীতির কথা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। আমি অন্য হাজারটি মানুষের দুর্নীতির কথা শুনতে রাজি আছি, কিন্তু একজন উপাচার্যেরও দুর্নীতির কথা শুনতে রাজি নই। যখন এটি ঘটবে তখন বুঝতে হবে লেখাপড়ার আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

এই উপাচার্যদের কেউ আকাশ থেকে এসে পড়েন না। অনেক বিচার-বিবেচনা করে সরকার থেকে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। আসলে যে যত ধরাধরি করতে পারবেন, তাঁর উপাচার্য হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। আমি নিজের কানে একজন উপাচার্যকে বলতে শুনেছি, তিনি আমাকে বলেছেন, ‘কোনো উপাচার্য যদি দাবি করেন তিনি কোনো রকম লবি না করে উপাচার্য হয়েছেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি চরম একজন মিথ্যাবাদী!’ যে দেশে লবি করে উপাচার্য হওয়া যায় বুঝতে হবে সেই দেশে লেখাপড়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। সেই দেশে লেখাপড়া নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। যেহেতু সরকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সত্যিকারের উপাচার্য পর্যন্ত নিয়োগ দিতে আগ্রহী নয়, তাই আমার মনে হয়েছে এই দেশে আমাদের লেখাপড়া নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। যদি লেখাপড়ার দিকেই আগ্রহ না থাকে তাহলে গবেষণার দিকে আর কার আগ্রহ থাকবে? আমাদের সারা জীবন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠাতে হলে ফ্রান্স থেকে স্যাটেলাইট কিনতে হবে, ইলন মাস্কের কাছ থেকে রকেট কিনতে হবে। করোনার টিকার জন্য টাকার বান্ডিল নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে। এই দেশের সোনার টুকরা মেধাবী ছেলেমেয়েরা আমেরিকা, ইউরোপে থেকে গবেষণা করবে, ডিসেম্বর মাসে দেশে বেড়াতে এসে আমাদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।

কিন্তু আমাদের দেশ এখন একটা ক্রান্তিকালে পৌঁছেছে। আমরা এখন দুঃসহ দরিদ্র নই, টাকার জন্য এখন কিছু আটকে থাকে না। আমরা ইচ্ছা করলে এখন সবকিছু ঠিক ঠিক চালাতে পারি। এই দেশে এখন বিশাল একটি তরুণ গোষ্ঠী, তাদের ঠিক ঠিক লেখাপড়ার সুযোগ দিলেই তারা দেখতে দেখতে একটা দক্ষ জনশক্তি হয়ে যাবে। গবেষণার পরিবেশ করে দিলেই এই দেশে বিশাল গবেষণা হতে পারে। আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েরা তাদের যোগ্য সুযোগ পেলেই দেশে ফিরে আসতে থাকবে। স্কুল–কলেজের লেখাপড়া আধুনিক করে দেওয়া যেতে পারে। পরীক্ষার অশুভ চক্র থেকে তাদের বের করে আনা যেতে পারে। কোচিংকে আইন করে বন্ধ করতে হবে না, সেটা অর্থহীন হয়ে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে। একটুখানি চাইলেই যে দেশের কোটি কোটি ছেলেমেয়েকে আনন্দময় একটা জীবন দেওয়া যেতে পারে, কেউ কি সেটা অনুভব করতে পারে না?
হাত বাড়ালেই বন্ধ দরজা স্পর্শ করতে হবে কে বলেছে, হাত বাড়ালেই রয়েছে অসীম দিগন্ত, আমরা সেটা স্পর্শ করার চেষ্টা করব না?

লেখক : মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কথাসাহিত্যিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0054140090942383