নজরুল ইসলাম ঋতু। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। দেশে চেয়ারম্যান আছেন আরও হাজার হাজার। কতজনের কথাই বা জানে দেশের মানুষ। কিন্তু ঋতুর কথা জানবে। তাঁর সংগ্রাম-সাফল্যের গল্প পড়ে বড় হবে শিশুরা। ঋতুর গল্প-ছবি এখন বইয়ের পাতায়। তিনি দেশের প্রথম নির্বাচিত তৃতীয় লিঙ্গের চেয়ারম্যান।
বছরের শুরুতেই সারা দেশের স্কুলশিক্ষার্থীরা হাতে পেয়েছে নতুন বই। সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৫২ নম্বর পৃষ্ঠায় সম্প্রদায় অধ্যায়ে ছাপা হয়েছে ঋতুর একটি ছবি। একই অধ্যায়ে সমাজজীবনে এবং পেশাগত জীবনে সংগ্রামী তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) লিনিয়া শাম্মী, রানী চৌধুরী ও বিপুল বর্মণদের কথাও আছে। বইয়ে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, জন্মের পর খুব অল্প বয়সে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে গুরুমার কাছে চলে যেতে হয় তৃতীয় লিঙ্গের শিশুদের। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ একে অপরের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে একটি পরিবারের মতো বসবাস করে। তারা শিশু আর নতুন বর-বউকে আশীর্বাদ করে টাকা উপার্জন করে। তারা স্বাভাবিক মানুষের মতো লেখাপড়া ও চাকরি করতে চাইলেও অন্যরা আর তাদের সমাজে নিতে চায় না। অন্য দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। তবে, ২০১৩ সালে সরকার তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজে নিচ্ছে। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
নজরুল ইসলাম ঋতু ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী নজরুল ইসলাম ছানাকে ৫ হাজার ২৮ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে চেয়ারম্যান হন তিনি। ভোটে নির্বাচিত হওয়ার আগে-পরে বিবিসি, সিএনএনসহ বাংলাদেশ এবং বিশ্ব গণমাধ্যমে উঠে আসে ঋতুর নাম। ফলাও করে তাঁর জীবনসংগ্রামের নানা দিক তুলে ধরা হয়।
ঋতু ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের মৃত আব্দুল কাদেরের সন্তান। তাঁর আরও তিন ভাই ও তিন বোন। তিন ভাই ঢাকায় থাকেন ও বোন তিনজনের বিয়ে হয়ে গেছে। জন্মের পর তৃতীয় লিঙ্গ প্রকাশ পাওয়ায় মাত্র সাত বছর বয়সে তাঁকে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে যেতে হয়। লেখাপড়া শুরু করলেও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতায় প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনো হয়নি। ছোটবেলা থেকে ঢাকার ডেমরায় দলের গুরুমার কাছেই বেড়ে ওঠা ঋতুর। এখন তাঁর বয়স ৪৪ বছর।
চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত ঢাকায় থাকলেও পরিবারের টানে প্রায়ই বাড়িতে আসতেন। নিজের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে দাদপুর গ্রামসহ ইউনিয়নবাসীর উন্নয়নে সহযোগিতা করতেন। এ পর্যন্ত এলাকায় দুটি মসজিদ করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্দিরের উন্নয়নে অর্থ দান করেছেন।
এলাকার কেউ অসুস্থ বা কন্যাদায়গ্রস্ত হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে কখনো খালি হাতে ফেরেননি। কয়েক বছর আগে গ্রামের বাড়ি দাদপুরে বানিয়েছেন একটি পাকা বাড়ি। বর্তমানে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ঋতু।
পাঠ্যবইয়ে ছবি ছাপা হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম ঋতু বলেন, ‘এটা আমার জন্য বিশাল একটা পাওয়া। আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। মানুষের উন্নয়নে ভালো কিছু করতে চাই।’
রাজনীতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গে ঋতু বলেন, ‘সত্যি বলতে, নির্বাচন কী তা বুঝিনি। হঠাৎ নির্বাচন এল, এলাকার মানুষ আমাকে ভালোবেসে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রথমে আনন্দ অনুভব করলেও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। প্রতিপক্ষের লোকজন আমার সব পোস্টার ছিঁড়ে দিচ্ছিল। আমার কর্মী-সমর্থকদের মারধর করা হচ্ছিল। আমাকে ভোটের মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছিল না। তবে ভয় পেলেও বুঝতে পারছিলাম, জনগণ আমাকে ভালোবাসে, আমার সঙ্গে আছে। তাদের ভালোবাসা আমাকে সাহস জোগাচ্ছিল। তারপর এল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন, চেয়ারম্যান হয়ে গেলাম।’
দেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে ঋতু বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সমাজে অবহেলিত। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সমান অধিকার দেওয়া হয় না। সুযোগ পেলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে দক্ষ জনবল করার ব্যবস্থা করব।’
কালীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদ জানান, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে কর্মজীবনে সাফল্য পাওয়া তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের কথা তুলে ধরা হয়েছে বইতে।
ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম বলেন, ‘চেয়ারম্যান হওয়ার পর ঋতু আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাঁকে সব সময় উৎসাহিত করি। তাঁর বিষয়টি পাঠ্যবইয়ে এসেছে, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মানুষের জন্য কাজ করছেন। এটা দেখে তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষ আরও উৎসাহিত হবে।’