গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম চলমান। সেই সংস্কারে ঢেউ লেগেছে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে সেটা নিয়ে জল্পনা কল্পনারও অন্ত নেই। কিছু ক্ষেত্রে শঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
এর আগে আমরা দেখেছি, শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ অনুযায়ী প্রণীত পাঠ্যপুস্তকগুলো নিয়ে জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এই কারিকুলাম, শিখন পদ্ধতি এবং পাঠ্যপুস্তক নিয়ে প্রতিবাদ এসেছে ইসলামপন্থী, সেকুলার সব মহল থেকেই। বলা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকের অনেক কনটেন্টই ইসলামের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক ছিলো। ইতিহাসে ছিলো অখণ্ড ভারতের বয়ান। তাছাড়া মুসলিম শাসন আমলকে সচেতনভাবে বিকৃত ও নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া শিল্প ও সংস্কৃতি বইটা বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে, মুসলিম সন্তানদের নাচগানে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি করা হয়েছে বলেও সমালোচনা ছিলো। সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের শরিফার গল্প তীব্র বিতর্কের জন্ম দেয়। বলা হয়, এই গল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় এলজিবিটি (পশ্চিমে চালু হওয়া সমকামিতাকে বৈধতা দেয়ার আন্দোলন) মতাদর্শের প্রবেশ ঘটে। আলেম, উলামা এবং ইসলামপন্থী জনতার তীব্র প্রতিবাদের মুখে বিগত সরকার বাধ্য হয় গল্পটি অপসারণের সিদ্ধান্ত নিতে।
এবার শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ এর আলোকে লেখা পাঠ্যপুস্তকগুলো থাকছে না জেনে প্রাথমিকভাবে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে। সিদ্ধান্ত হয় ২০১২ এর পাঠ্যপুস্তকগুলো সংশোধন ও পরিমার্জনের। তবে এ বিষয়ে সমন্বয় কমিটি জনসম্মুখে প্রকাশ হবার পর থেকে আবারও বিতর্ক শুরু হয়। এই কমিটি কিভাবে হলো- এটা নিয়ে অনেক সংশয় এবং সন্দেহ তৈরি হয়৷ দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই কমিটিতে কোন শিক্ষাবিদ, কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ বা পেডাগোজি স্পেশালিষ্ট ছিলেন না। এই কমিটিতে উপেক্ষিত ছিলো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অংশীজনদের প্রতিনিধি।
সচেতন নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠন দাবি করে, এই কমিটিতে ইসলামপন্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। উপরন্তু, কমিটির কয়েকজন সদস্য এলজিবিটি মতাদর্শের সমর্থক হওয়ায় বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধনসহ নানা ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর সতেচন নাগরিক সমাজের ব্যানারে প্রেসক্লাবের সামনে কমিটির দুইজন সদস্য অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ও ড. সামিনা লুৎফাকে অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন করে। এর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই দুইজন কমিটি সদস্যের এলজিবিটি মতাদর্শকে প্রোমোট করা বিভিন্ন পোস্ট ভাইরাল হয়। এই মানববন্ধন থেকে পরবর্তী কারিকুলাম কমিটিতে ইসলামপন্থী শিক্ষাবিদ রাখারও দাবি জানানো হয়।
এর ফলশ্রুতিতে, সরকার পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনে গঠিত ওই কমিটি বাতিল করে। শিক্ষা উপদেষ্টার বরাতে জানা গেছে, পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ শেষের দিকে এবং মধ্য অক্টোবরে বই প্রেসে দেয়ার পরিকল্পনা আছে।
তবে নতুন বই কেমন হবে তা নিয়েও ধর্মপ্রাণ জনগণের মধ্যে শঙ্কা কাজ করছে। যেহেতু, এলজিবিটি মতাদর্শের সমর্থক কিছু মানুষও এই পাঠ্যপুস্তকের কাজ করেছেন, শব্দের মারপ্যাঁচে এলজিবিটি মতাদর্শের কোনো কন্টেন্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে। তাছাড়া ইসলাম শিক্ষা বইয়ের কাজ করেছেন আবু সাঈদ খান নামক একজন ঘোষিত হাদিস অস্বীকারকারী। এ নিয়েও গণপরিসরে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। আন্দোলনের ডাক আসছে বিভিন্ন সংগঠন থেকে৷ তাদের আলোচনা থেকে কয়েকটা দাবি উঠে এসেছে।
দাবিগুলো হলো- ১. কিসের ভিত্তিতে এই সমন্বয় কমিটি এবং সংশোধন ও পরিমার্জন টিম গঠিত হলো এবং কেনো সেখানে কোন শিক্ষাবিদ ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ রাখা হয়নি সেটা জাতির কাছে স্পষ্ট করতে হবে ২. এই টিমে ইসলাম শিক্ষা বইয়ের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের উপেক্ষা করে কেনো চিহ্নিত হাদিস অস্বীকারকারীকে স্থান দেয়া হলো তার জবাবদিহিতা করতে হবে ৩. বই ছাপার জন্য প্রেসে পাঠানোর পূর্বে ইসলামপন্থী শিক্ষাবিদদের একটা টিম দিয়ে রিভিউ করাতে হবে ৪. এলজিবিটিসহ ইসলামের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক কোন কনটেন্ট বইতে থাকা যাবে না ৫. গণমানুষের চাহিদাকে আমলে নিয়ে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতিফলন থাকতে হবে।
এই বাস্তবতায়, ধর্ম উপদেষ্টার নেতৃত্বে ইসলামপন্থী শিক্ষাবিদদের একটা টিম দিয়ে পাঠ্যপুস্তকগুলো রিভিউ করা জরুরি। গতবার এলজিবিটি মতাদর্শ ঢুকেছিলো ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান সাবজেক্টের মাধ্যমে। আপত্তিকর আলোচনাসহ বইগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে চলে গেলে তীব্র আন্দোলন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। যেটা সরকারের স্থিতিশীল হবার পথে প্রতিবন্ধক হতে পারে৷ তাছাড়া বই ছাপানোর পর বাতিল করতে হলে কোটি কোটি টাকা গচ্চাও যাবে। ফলে, বইগুলো আগেই রিভিউ করা হলে অনেক জটিলতা এড়ানো যাবে।
লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট