নানা বিতর্কের জেরে চলতি বছরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বিতর্কিত ‘সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের অনুসন্ধানী পাঠ’ নামে দুটি পাঠ্যবই প্রত্যাহারের পর সংশ্লিষ্ট চার কর্মকর্তা গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার পাঠ্যবই প্রত্যাহার করার মত ঘটনা ঘটার পর ‘কারা, কার নির্দেশে এবং কেন লিখেছে’-এসব প্রশ্নের উত্তর ওই চার কর্মকর্তার কাছ থেকে পেতে চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। গত একমাসে কয়েকদফা জেরার মুখে পড়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বই লেখা হয়েছে বলে গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় সবমিলিয়ে পাঠ্যবই কেলেঙ্কারিতে সরকারের মুখ পুড়লেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় অভিযুক্তদের এখনো প্রত্যাহার করেনি কিংবা শাস্তির আওতায়ও আনেনি। বরং তারা ষষ্ঠ ও সপ্তমের পাঠ্যবইয়ে কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েও বহাল তবিয়তে রয়েছেন এবং এখন মহাসমারোহে আগামী বছরের অষ্টম, নবম ও দশমের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজ করছেন। এরফলে আগামী বছরও পাঠ্যবই নিয়ে আরেকপ্রস্থ বিতর্ক হাজির হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, পাঠ্যবইয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়ে প্রত্যাহার এবং এসব কাণ্ডে সরকারকে ডুবানোর কারিগর হচ্ছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ রাকিবুল হাসান খান, অধ্যাপক মো. মোখলেসুর রহমান ও গবেষণা কর্মকর্তা মুরশিদ আক্তার। চলতি বছরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামের সবকিছু এই চারজনের নেতৃত্বে হয়েছে। এনসিটিবিতে তারা ‘চার খলিফা’ নামে পরিচিত। তারাই বিভিন্ন এনজিও এবং কম জানা লোকেদের ভাড়া করে এনে এবারের পাঠ্যবই প্রণয়ন করেছেন।
এনসিটিবি থেকে তাদের কর্মকান্ডে কেউ বাধা দিলে তাকে পাল্টা বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে শিক্ষামন্ত্রী তাদেরকে ‘ব্ল্যাঙ্কচেক’ দিয়ে রেখেছেন। যারাই তাদের বিরোধিতা করেছিলেন ওই সময়ে তাদেরকে কোনঠাসা করে রেখেছিলেন তারা। অথচ বই প্রণয়নের আগে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বই থেকে কিছু অংশ বাদ দিতে বলেছিলেন। কিন্তু এই চারজন বই থেকে কোনো অংশই বাদ দেননি। এর ফলে শিক্ষার্থীদের হাতে বই যাওয়ার পর চরম বিতর্ক শুরু হলে সরকার বাধ্য হয় দুই শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই প্রত্যাহার করে নিতে।
সূত্রমতে, ‘চার খলিফা’র কারণে পাঠ্যবই প্রণয়নে সরকারের গত ১২ বছরের সফলতা এবার ম্লান হয়েছে। আর এই অভিযোগ তারা গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকারও করেছেন। এখন বিপদ থেকে বাঁচতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা নির্দেশকে সামনে এসে হাজির করছেন তারা।
এদিকে, গত ৩০ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তকে ভুল এবং এই ভুল যারা করেছেন এবং এনসিটিবির কোন কোন কর্মকর্তা জড়িত তাদের খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত কমিটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটির আহ্বায়ক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার। এ কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে হবে ২১ কর্মদিবসের মধ্যে। গতকাল পর্যন্ত এই কমিটি প্রতিবেদন দেয়নি।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার গতকাল বলেন, আমাদের কাজ প্রায় শেষের দিকে। শিগগিরই আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেব। পাঠ্যবইয়ে ভুলের জন্য দায়ী কে, তদন্তে এমন কিছু পাওয়া গেছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগ পর্যন্ত আগেভাগে কিছু বলতে পারি না। প্রতিবেদন দেয়ার পর আপনারা দেখে নিলেই সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন।
গোয়েন্দা সংস্থাও নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা তাদের মতো কাজ করছেন। আমরা আমাদের মতো কাজ করছি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পাঠ্যবইয়ে ভুলক্রটি, বিতর্কিত পাঠ ও ছবি সংযোজনের ঘটনায় চটেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। বিশেষ করে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মূল পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু বিষয় বাদ দিতে বলেছিলেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেগুলো বাদ দেয়া হয়নি। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে সরকার।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির পর তা শিক্ষামন্ত্রীকে দেখানো হয়। তিনি বিশেষ করে পরামর্শ দেন সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের কিছু ছবি ও পাঠ বাদ দেয়ার। পাশাপাশি ইতিহাসের বর্ণনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পরামর্শ দেন। কিন্তু এবার সামাজিক বিজ্ঞানের জন্য যে দুটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হয়েছে, তার একটি থেকে কিছু ছবি বাদ দেয়া হলেও পাঠ সংশোধন করা হয়নি। আর অপর বইটিতে ছবি এবং পাঠ কিছুই বাদ দেয়া হয়নি। এছাড়াও ষষ্ঠ শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান ও ইতিহাস বইতে গ্রিক দেবদেবী থেকে শুরু করে বানর-মানুষ ছবি দিয়ে বইগুলো বিতর্কিত করা হয়েছে। অথচ এসব বই ষষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের পড়ার সক্ষমতা নেই। তাদের এমন কর্মকাণ্ডে প্রতিক্রিয়াশীলদের জয় হয়েছে।
সূত্র জানায়, এ বইটি একদম শেষ মুহূর্তে এনসিটিবিতে জমা দেয়া হয়। সে কারণে কোনো ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই মুদ্রণে পাঠানো হয়। ফলে অপ্রত্যাশিত বিষয় থেকে যাওয়ায় সমালোচকদের বিতর্ক সৃষ্টির পথ তৈরি করে দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, শিক্ষামন্ত্রী নিজে কিছু ছবি বাতিল করে দিলেও সেগুলো রাখা হয়েছে। যদি মন্ত্রীর পরামর্শ বাস্তবায়িত হতো তাহলে এখন বিতর্ক উঠত না।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পাঠ্যবই কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত চার কর্মকর্তার প্রধান হলেন অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। গোয়েন্দারা তার কাছে যা জানতে চেয়েছেন তার উল্লেখযোগ্য অংশ জানিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষা প্রণয়নের প্রক্রিয়া কি, কখন কিভাবে পাঠ্যবই লেখা হয়েছে, কারা লিখেছে, কেন এমন লিখেছে তা জানতে চেয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিসহ আমরা সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি তাদের।
এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ রাকিবুল হাসান খান। তার কর্মকাণ্ডে শিক্ষামন্ত্রীও অসন্তুষ্ট হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, রাকিবুল হাসান খানই পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্কিত লেখা জুড়ে দেয়ার সুপারিশ করেছেন বেশি। সব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যা বলার বলবেন মেম্বার (কারিকুলাম) স্যার। তিনি আমাদের বলতে নিষেধ করেছেন।
আরেক অভিযুক্ত অধ্যাপক মোখলেসুর রহমান বলেন, বিষয়টি তদন্তাধীন থাকায় এখন কিছু বলা সম্ভব নয়।
গবেষণা কর্মকর্তা মুরশীদ আক্তার বলেন, ওপর থেকে যা করতে বলা হয়েছে তাই তিনি করেছেন।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অষ্টম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবই তৈরিতে সতর্কতা অবলম্বন করছে এনসিটিবি। এক্ষেত্রে বইয়ের পাঠ নির্বাচনের পাশাপাশি লেখক এবং সম্পাদক নির্বাচনেও অবলম্বন করা হচ্ছে সতর্কতা।