নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইয়ের ভুল চিহ্নিত করে সংশোধন করতে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটিতেই দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে ভুল সংশোধনের বিশেষজ্ঞ কমিটি ও গাফিলতি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম ওয়াহিদুজ্জামান কমিটিতে কাজ করতে চাচ্ছেন না।
গোড়াতেই দ্বন্দ্ব
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ উপাচার্য দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানিয়েছেন, কমিটির সদস্য করার বিষয়ে তাকে জানানো হয়নি। তিনি জানতেন, তিনি কমিটির আহ্বায়ক হচ্ছেন। কিন্তু তাকে সদস্য করায় তিনি পাঠ্যবইয়ের ভুল সংশোধন কমিটিতে কাজ করবেন না। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দৈনিক আমাদের বার্তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা জানান।
দৈনিক আমাদের বার্তাকে অধ্যাপক এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আমি কারো চাকরি করি না। আমি শিক্ষক-শিক্ষাবিদ। আমি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। আমার একটা মর্যাদা আছে। আমি জুনিয়রদের অধীনে কাজ করবো না। কমিটিতে রাখার বিষয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করা দরকার ছিলো।
তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠনের নির্দেশনা ছিলো। সেটি যদি তারা (শিক্ষা মন্ত্রণালয়) চেঞ্জ করে তাহলে আমি কাজ করবো কেনো। তারা তো আমাকে এ বিষয়ে জানাননি। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাকে এ বিষয়ে জানানো হয়নি।
জানা গেছে, বিশেষজ্ঞ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে আইইআরের পরিচালক ড. আব্দুল হালিমকে। তার সঙ্গে কাজ করতে অসুবিধা কোথায় জানতে চাইলে অধ্যাপক এম ওয়াহিদুজ্জামান দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমি সিনিয়র লোক, আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। আমি কেন কাজ করবো। আমি বাধ্য না।
প্রসঙ্গত, বিশেষজ্ঞ কমিটি নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ভুল বা অসংগতি চিহ্নিত করে তা সংশোধনের সুপারিশ করবে। আর তদন্ত কমিটি কারো গাফিলতি বা ইচ্ছাকৃত ভুল ছিলো কি-না তা খতিয়ে দেখবে। বিশেষজ্ঞ কমিটিকে ১ মাস ও তদন্ত কমিটিকে তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. আব্দুল হালিমকে। সদস্য হিসেবে আছেন আইইআরের অধ্যাপক এম ওয়াহিদুজ্জামান, এনসিটিবির সদস্য মো. লুৎফর রহমান, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের একজন উপসচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুন্নাহার শাহীন। এ কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজিজ উদ্দিন।
অপরদিকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তারকে। এ কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন একই বিভাগের যুগ্মসচিব মোল্লা মিজানুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন পরিচালক, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের একজন উপসচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক সিরাজুল ইসলাম খান, বিএএফ শাহীন স্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. আব্দুল মান্নান মিয়া। এ কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন উপসচিব মো. মিজানুর রহমান।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের অসংগতি, ভুল, ত্রুটি, চিহ্নিত করে তা সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। এ কমিটি এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। প্রয়োজনে কমিটি ২-৩ জন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে পারবে।
অপরদিকে তদন্ত কমিটি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের অসংগতি, ভুল তথ্য সন্নিবেশ হয়ে থাকলে তা পর্যালোচনা করে এ কাজে কারো গাফিলতি বা ইচ্ছাকৃত ভুল ছিলো কি-না তা চিহ্নিত করে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। এ কমিটিকে তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটি প্রয়োজনে এনসিটিবির সহযোগিতা নিতে পারবে। আর একজন সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে।
২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের নতুন পাঠ্যবইয়ে ভুল ও অসঙ্গতি নিয়ে গত ২৪ জানুয়ারি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অডিটোরিয়ামে ‘নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ক’ এক সংবাদ সম্মেলনে দুই কমিটি গঠনের কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। পাঠ্যবইয়ে ভুল চিহ্নিত করে সংশোধন করতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কেউ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল করেছে কিনা তার তদন্ত করতে আরেকটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী।
কমিটিতে সেই উপাচার্য
নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবইয়ে ভুল চিহ্নিত করে সংশোধন করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠন করা বিশেষজ্ঞ কমিটিতে আছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক এই অধ্যাপক এ কমিটির সদস্য। নোবিপ্রবির উপাচার্য পদে কর্মরত থাকার সময় তার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিলো। যার প্রমাণ পেয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।
জানা গেছে, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝিতে নোবিপ্রবির উপাচার্য পদে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ইউজিসির তদন্তে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের অধিকাংশই প্রমাণিত হয়। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয় ইউজিসি।
ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে এম অহিদুজ্জামানের মেয়াদকালে নোবিপ্রবিতে অনিয়ম করে নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সে সময় অনিয়ম করে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে আছেন- বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সুবোধ কুমার। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির সহকারী অধ্যাপক পদে চাকরির জন্য আবেদন করলেও শিক্ষক হিসেবে যোগদানের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। অ্যাডহক ভিত্তিতে যোগদানের আবেদন করেন তিনি। অদৃশ্য কারণে আবেদনের দিনই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান ড. সুবোধ। তারপর সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগের বাছাই বোর্ডে তিনি অযোগ্য বিবেচিত হওয়ার পরও শিক্ষকতা ছাড়তে হয়নি। উল্টো আরেক ধাপ এগিয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি।
বিতর্কিত নিয়োগ পাওয়া অপর শিক্ষক অধ্যাপক গাজী মো. মহসীন। আগে শিক্ষকতার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগ দেন তিনি। নিয়োগের মতো পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন সুবিধা পান তিনি। সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগের দুই বছরের মাথায় অধ্যাপক বনে যান তিনি। একইভাবে ড. মো. রোকনুজ্জামান সিদ্দিকী, মো. আতিকুর রহমান ভূঁইয়া, মো. মোকাম্মেল করিমসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষককে অনিয়ম করে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়া হয়।
কর্মকর্তা নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রেও এম ওয়াহিদুজ্জামানের স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ পেয়েছিলো তদন্ত কমিটি। ডা. লোপা দাস বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদানের ১ বছর ৮ মাসের মাথায় সিনিয়র মেডিকেল অফিসার পদে নিয়োগ পান। যদিও এ পদে নিয়োগের জন্য পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক। একইভাবে ইউজিসির ওই তদন্ত প্রতিবেদনে মো. আনোয়ারুল ইসলাম, ইশমত আরা পারভীন, এএইচএম নিজাম উদ্দিন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নোবিপ্রবির বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিদারুল আলমকে চিঠি পাঠিয়েছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এসব অনিয়মের বিষয়ে অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, সব নিয়োগ ও পদোন্নতি বিধি ও সময় অনুসরণ করে দেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ অভিযোগই মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যারা তদন্ত করেছেন তারা কি করেছেন জানা আছে। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি কোনো অনিয়ম হয়নি। কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে, নিয়োগ হয়েছে অনিয়ম হয়নি। যড়ষন্ত্রমূলকভাবে তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলা হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।