পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) নানা প্রকল্পে অনিয়ম এবং দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) থেকে প্রকাশিত ২০২২-২৩ নিরীক্ষা বছরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও ২৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্টে পাবিপ্রবিতে চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম এবং অসংগতি ধরা পড়ে। সিএজির অডিট রিপোর্টে প্রকল্প নিয়ে ১৫টি বিষয়ের ওপর শতকোটি টাকার বেশি অডিট আপত্তি এসেছে, যার ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাকিলা জামানের নেতৃত্বে চার সদস্যদের একটি নিরীক্ষক দল সম্প্রতি বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
জানা গেছে, নিরীক্ষা দলের অডিট প্রতিবেদনে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, পাবিপ্রবিতে বাজেটের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত ভাতা প্রদান, প্রাপ্যতা ছাড়া ভাতা প্রদান, ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া বিধিবহির্ভূত চুক্তিভিত্তিক জনবল নিয়োগ, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না করা, প্রকল্পে বরাদ্দের অতিরিক্ত অনিয়মিত ব্যয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে আয়কর ও ভ্যাট কর্তন না করা, অর্থিক বিধি লঙ্ঘন করে ফিলিং স্টেশনকে প্রাপ্যতাবিহীন সুবিধা দেওয়া, প্রকল্পের জামানত থেকে অর্জিত সুদ সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া, ডিপিপি লঙ্ঘন করে আসবাবপত্র ক্রয়, প্রচার ও বিজ্ঞাপনের বিলে সারচার্জ না কাটা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করে ডিনের দায়িত্ব প্রদান, চুক্তিমূল্যের অতিরিক্ত অর্থ ঠিকাদারকে দেওয়া, ডিপিপিতে নির্ধারিত কাজ বাস্তবায়ন না করা, পদ ছাড়াই অর্গানোগ্রাম বহির্ভূতভাবে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া আয় বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটে না দেখানো, নিম্নমানের বই সরবরাহ প্রভৃতি খাতে শতকোটি টাকার বেশি অনিয়ম করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, পাবিপ্রবিতে বর্তমানে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয়শ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। অনিয়মের খাতগুলোতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া নিজস্ব আয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে না দেখানোয় সরকারের ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। উপরেজিস্ট্রার, উপগ্রন্থগারিক, উপপরিচালক ও উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে বিধিবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি দেওয়ায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১৯ লাখ ৮২ হাজার ৭ শত টাকা। প্রিয়াংকা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন এবং ইঞ্জিনিয়ার্স কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে চুক্তিমূল্যের অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয় ৪১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করে অধ্যাপক সাইফুল ইসলামকে ডিন নিয়োগ দিয়ে তাঁকে ভাতা দেওয়ায় ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা ক্ষতি হয় সরকারের। ডিপিপিতে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আসবাব কেনার কথা থাকলেও সরাসরি আর্থিক ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে ক্রয় করায় অনিয়ম হয়েছে ১৫ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার ১৩৩ টাকা। উন্নয়ন প্রকল্পের জামানত থেকে অর্জিত সুদ সরকারি কোষাগারে জমা না করে সম্মানি, টিএ-ডিএ এবং আপ্যায়নের নামে খরচ করা হয়েছে, যাতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৫৪ হাজার ৮৭৮ টাকা।
আর্থিক বিধান ছাড়াই জ্বালানি সরবরাহ বাবদ ফিলিং স্টেশনকে অগ্রিম অর্থ দেওয়া হয়েছে। এতে অনিয়ম হয়েছে ৩৭ লাখ টাকার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল থেকে নির্ধারিত হারে আয়কর না কাটায় ২ কোটি ৪২ লাখ ৩৮৪ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত অনিয়মিত ব্যয় করা হয়েছে ৫২ কোটি ২৮ লাখ ৪২ হাজার টাকা। ইঞ্জিনিয়ার্স কনসর্টিয়াম লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করায় সরকারের ক্ষতি ২৮ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন খাতে আর্থিক তছরুপের প্রমাণ মিলেছে।
এ ব্যাপারে পাবিপ্রবির ট্রেজারার ড. একেএম সালাাহ উদ্দিনের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে আর্থিক অনিয়ম সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পবিষয়ক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জি এম আজিজুর রহমান (অব.) বলেন, অডিট আপত্তি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। যারা অডিট করেছে তারা আমাদের জানিয়েছে। আমরা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছি। যদি কোনো বিষয় থাকে, তবে সরকারের টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত যাবে।
পাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক হাফিজা খাতুন বলেন, ‘বিষয়টি আমি যোগদানের আগের ঘটনা। আমরা অডিটকারীদের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে কাজ করার চেষ্টা করব।’
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত পাবনা জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক খায়রুল হক বলেন, অডিট আপত্তির বিষয়টি দুদক খতিয়ে দেখবে। কোনো দুর্নীতি পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।