ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হওয়া প্রয়োজন? এটি এখন আমাদের সমাজে চারপাশে বহুল উচ্চারিত প্রশ্ন। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যে খুব একটা পারস্পরিক সম্মানজনক অবস্থায় নেই, তা বোঝার জন্য সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনাই যথেষ্ট। কিছুদিন পরপরই একেকটি ঘটনা সামনে এসে বিষয়টি যে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই, সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। সম্প্রতি, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের চুল কেটে দেওয়া নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের মানসিকতার ধারণাটিও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।
এর আগেও দেখা গেছে, নুসরাত হত্যার সঙ্গে সোনাগাজীর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সরাসরি জড়িত। দুই বছর আগে রাজধানীর ডেমরার ডগাইর এলাকার নূরে মদিনা মাদ্রাসার ছাত্র আট বছরের মনির হোসেনকে হত্যার সঙ্গে ঐ মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ দুই শিক্ষার্থী জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পেয়ে অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। একজন অধ্যক্ষ তার দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে বসে অপহরণের পরিকল্পনা করছে, তাকে হত্যা করছে এসব অকল্পনীয়!
অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনাগুলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পবিত্র ও সম্মানের সম্পর্ককে রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। পরীক্ষার হলে চুল কেটে দেওয়ার ঘটনা এর আগেও দেখা গেছে। চুল কেটে দেওয়ার অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে দেখা গেছে একাধিক শিক্ষার্থীকে। কয়েক বছর আগে অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনাটি অনেকের মনে আছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এই ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাটি দেশে তোলপাড় ফেলে দেয়। সেই ঘটনায় গ্রেফতার হন অভিযুক্ত শিক্ষিকাও। তিন জন সাময়িক বরখাস্ত হন।
সাম্প্রতিক এ ঘটনা প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম বলেন, এ ধরনের ঘটনা কাঙ্ক্ষিত নয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে গুরু-শিষ্যের মতো, বন্ধুর মতো। কিন্তু যা ঘটেছে তা নিষ্ঠুরতার আরেক নাম। এ ধরনের কর্মকাণ্ড মানবাধিকার লঙ্ঘন।
আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা প্রক্রিয়ায় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করতে দেখা যায়। এসব নির্যাতন যেমন কোমলমতি শিশুদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অন্তরায় তৈরি করে, তেমনি শিক্ষকতা পেশার জন্যও নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে। এদেশে শিক্ষক কর্তৃক নির্যাতনে মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি এমনকি ছাত্র মৃত্যুর ঘটনার ইতিহাসও আছে। অথচ পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশে বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষিত শিক্ষক, উন্নত ও গঠনমূলক পাঠ্যসহ পাঠদান পদ্ধতির পাশাপাশি ছাত্রনির্যাতনের বিরুদ্ধেও কঠোর আইন রয়েছে।
শিক্ষকদের মতো আমাদের অভিভাবক বা মা-বাবার সঙ্গেও সন্তানদের সম্পর্ক বন্ধুর মতো না। অথচ একজন ছাত্রের ভালো লেখাপড়ার পেছনে তার শিক্ষক ও অভিভাবকের গুরুত্ব সমান। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, কেউ কি জানে না যদি এই শিশু-কিশোরদের গভীর মমতা দিয়ে ভালোবাসা যায়, তাহলে শুধুমাত্র ভালোবাসার মানুষটি যেন মনে কষ্ট না পায় সেজন্য তারা কখনো কোনো অন্যায় করে না। কেউ কি জানে না এই বয়সটি কী অসম্ভব স্পর্শকাতর একটি বয়স? কেউ কি জানে না অপমানের জ্বালা কত তীব্র? কেউ কি জানে না পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ব্যবহার করেও একটি হারিয়ে যাওয়া প্রাণকে ফিরিয়ে আনা যায় না?
অপরদিকে, এটাও দেখা যায় যে, আমাদের বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিও স্বচ্ছ নয়। শিক্ষকদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে কলেজে চাকরি পেতে হয়। এ নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও যুক্ত থাকেন—এ ধরনের খবরও প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে। এসব যখন হয় তখন সেই শিক্ষক স্বাভাবিকভাবেই সবার কাছে সম্মান হারান। অর্থের বিনিময়ে চাকরি নেওয়ায় তার নিজেরও নীতিবোধ খুব জোরালো থাকে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো। প্রত্যেক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের বাইরে কিংবা একাডেমিক কাজ ছাড়াও কথা বলার সময় দিতে হবে। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের সময় দেন তা হলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় ভালো হয়ে উঠবে। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকরা শুধু শিক্ষাদাতা নন, তাদের গাইডও বটে। কেননা, বাংলাদেশের বাস্তবতায় সব শিক্ষার্থী শিক্ষিত পরিবার থেকে আসে না। তাদের কাছে শিক্ষকরাই হন সবচেয়ে কাছের মানুষ।
কয়েক দশক আগেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিল গুরু শিষ্যের। শিষ্য যে ভক্তি নিয়ে শিক্ষককে সমীহ করতেন শিক্ষকরাও সেই মর্যাদাকে ধরে রাখতে নিজেদের সেই উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার মতো করেই পড়াশোনা করাতেন। নিজেরা আদর্শবান হতেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের কারণে এমনটা ঘটছে। শিক্ষা জ্ঞান আহরণের মাধ্যম আর নেই। শিক্ষা হয়ে গেছে ভালো চাকরি পাওয়ার সিঁড়ি। আমাদের শিক্ষকরাই স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব শেখাচ্ছেন। বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে বলেই একই শিক্ষকের ক্লাস করে এসে তার কাছেই প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী নেই।