এইচএসসির ফল পরিবর্তন ও পাসের দাবিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছেন অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা । এ সময় বোর্ডের ফটকে তালা ঝুলিয়ে নানা স্লোগান ও কয়েকটি স্থানে সড়ক অবরোধের ঘটনাও ঘটেছে। আন্দোলনে একাধিক বোর্ডের চেয়ারম্যান পরীক্ষার্থীদের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বিক্ষোভের সময় ধাক্কাধাক্কিতে অন্তত ছয় শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রকাশিত ফলকে বৈষম্যমূলক বলছেন। তারা সবগুলো বিষয়ের ওপর সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল চান। এসএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতেই সেই সাবজেক্ট ম্যাপিং করার দাবি তাদের।
রোববার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল বাতিল করে পুনরায় ফল তৈরি ও প্রকাশের দাবি জানিয়ে প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন ফেল করা একদল শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে তারাই আবার ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েন। বেলা ১১টা থেকে এ বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয়। তাদের সঙ্গে অনেক নারী অভিভাবককেও দেখা যায়। দুপুর পৌনে দুটার দিকে বোর্ডের প্রধান ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এদিকে, দুপুর দুটার দিকে শিক্ষা বোর্ডের প্রবেশ পথে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে তিন ছাত্রীসহ ছয়জন আহত হন।
আহতরা হলেন ভোলার লালমোহন সরকারি সাহবাজপুর কলেজের শিক্ষার্থী সাগর (১৭), নারায়ণগঞ্জ কলেজের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার (১৮), কেরানীগঞ্জ বাঘাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ফাহমিদা হোসেন প্রিয়াংকা (১৭), ওলি নেওয়াজ খান কলেজের শিক্ষার্থী ওয়াহিদ (১৯), গোপালগঞ্জ শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ কলেজের শিক্ষার্থী আশুতোষ দাস (১৮) ও ময়মনসিংহর ভালুকা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী জান্নাতুল দৃষ্টি (১৮)।
আহতরা জানান, এইচএসসির ফল নিয়ে আমাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে আমরা সব শিক্ষার্থী যোগাযোগ করে দুপুরে শিক্ষা বোর্ডে এসেছিলাম চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। আমরা প্রতিবাদ করায় তিনিসহ তার লোকজন আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। এতে বেশ কয়েক শিক্ষার্থী আহত হন। আমরা এই হামলার বিচার চাই এবং শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করছি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. ফারুক জানান, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে ছয় শিক্ষার্থী আহত হয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন। তাদের জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করেন। ঘটনাস্থলে থাকা চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীরা প্রথমে বোর্ডের ফটকে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। ভেতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। সে সময় গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নিয়ে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভেতরে ঢুকতে চাইলেও তাদের যেতে দেওয়া হয়নি। তাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কিছুটা ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে পুলিশ।
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে বাতিল পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল তৈরি করা হয়েছে। এখানে কেউ বঞ্চিত বা বৈষম্যের শিকার হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তার পরও শিক্ষার্থীরা কী বলতে চায়, তাদের কথা আমরা শুনব। সেগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানাব।
সর্বশেষ শিক্ষার্থীরা ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকারের কক্ষে ঢুকে পড়েন। বোর্ড চেয়ারম্যানকে ঘিরে সেখানে বিক্ষোভ করেন তারা। ফল বাতিলের ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত তারা সেখান থেকে যাবেন না বলে ঘোষণা দেন।
এদিকে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের ফটকে তালা ঝুলিয়েছেন একদল শিক্ষার্থী। অবরুদ্ধ করে রাখা হয় বোর্ড চেয়ারম্যান ড. নিজামুল করিমকে। রবিবার বেলা ১১টা থেকে কুমিল্লা বোর্ডের অন্তর্গত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সেখানে অবস্থান নেন। এ সময় তারা শিক্ষা বোর্ডের প্রধান ফটক ও বোর্ডের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের ভবনের ফটক আটকে দেন। এ সময় শিক্ষা বোর্ড শাখার সোনালী ব্যাংকের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসারসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাগ্বিত-া হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপদে সরিয়ে নেন। বিকেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসির ফলাফলে পাসের হার ছিল ৭১ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ বছর ১ লাখ ১২ হাজার ৩১২ জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৭৯ হাজার ৯০৫ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। এতে ফেল করে ৩২ হাজার ৪০৭ জন।
ফেল করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি অংশ রবিবার বেলা ১১টার দিকে বোর্ডে ঢুকে পড়ে। তারা বৈষম্যহীন ফল দাবি করে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। পরে শিক্ষার্থীরা কুমিল্লা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবরে ঘোষিত ফল প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যহীন ফল প্রকাশের এক দফা দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দেন। এতে তারা রবিবারের মধ্যেই বৈষম্যহীন ফল নির্ধারণের জোর দাবি জানান।
সন্ধ্যায় বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. নিজামুল করিম জানান, শিক্ষার্থীদের স্মারকলিপি পেয়েছি। বিকেল তিনটা পর্যন্ত শিক্ষার্থী, ছাত্র সমন্বয়ক এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। স্মারকলিপিটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে। সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মাধ্যমিকের ফল অনুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করেন সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা। রবিবার বেলা ১১টার থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত নগরীর মুরাদপুরের শিক্ষা বোর্ডের মূল ফটকের সামনে এবং অভ্যন্তরে অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি পালন করা হয়। দাবি মানা না হলে সড়ক অবরোধসহ কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
সদ্য প্রকাশিত এইচএসসির ফলে বৈষম্য করা হয়েছে দাবি করেন অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীরা। তারা বলেন, সাবজেক্ট ম্যাপিং যথাযথ হয়নি। বৈষম্য করেই ফেল করানো হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে চট্টগ্রামের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সর্বদা রাজপথে ছিল, অথচ বৈষম্য করা হয়েছে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে। মাধ্যমিকের ফল অনুযায়ী এইচএসসির ফল প্রকাশ হলে এমন পরিস্থিতি হতো না।
এদিকে বারংবার শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও কর্মসূচির কারণে প্রতিষ্ঠানটির কাজেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। পুলিশ-সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হলেও বোর্ড কর্মকর্তারা বারবার অবরুদ্ধ হওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকদের কাছে জানান, বৃহস্পতিবার কর্মসূচি থেকে বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল। তিনি দাবি মানা হবে বলে আশ^াস দিয়েছিলেন। রবিবার শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিলেও জানতে পেরেছি, দাবি মানা হবে না। তাই আমরা ভবিষ্যতে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নেব। ইচ্ছা করে ফেল করানো হয়েছে, এটা বৈষম্য। এসব ফল নতুন বাংলাদেশে বঞ্চিত পরীক্ষার্থীরা মেনে নেবে না। পরীক্ষার দেওয়ার পরও কীভাবে অনুপস্থিত আসে, ফেল আসে।
অনেক বোর্ডে দুই বিষয় পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীদের পাস দেখানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বোর্ডে কিন্তু বৈষম্য করা হয়েছে, যথাযথভাবে খাতার মূল্যায়ন হয়নি। রবিবার কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শিক্ষা বোর্ডে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিয়ে কর্মসূচি পালন করেন।
যশোর শিক্ষা বোর্ডে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় খারাপ ফল করা শিক্ষার্থীরা। রবিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শিক্ষা বোর্ডে অবস্থান নেন বিভিন্ন কলেজের শতাধিক শিক্ষার্থী। দাবি আদায়ে তাদের বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। তাদের অভিযোগ, বোর্ড কর্তৃপক্ষ মনগড়া ফল দিয়েছে। যশোর বোর্ডের ইংরেজি প্রশ্ন সহজ আসার পরও গণহারে ইংরেজিতে ফেল করানো হয়েছে। সিলেট বোর্ডে মাত্র দুই বিষয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করা হলেও তাদের সবাইকে পাস করানো হয়েছে। যশোর বোর্ডে সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করা হয়নি। সাবজেক্ট ম্যাপিংও সঠিকভাবে করা হয়নি।
ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাতে যশোর বোর্ডের ফল খারাপ করা শিক্ষার্থীরা আবেদন ও প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে না। এর আগে সকাল থেকে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা বোর্ড প্রাঙ্গণে জড়ো হন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মিছিল নিয়ে বোর্ডে প্রবেশ করতে গেলে প্রধান ফটকে তালা দেয় কর্তৃপক্ষ।
পরবর্তীতে তালা ভাঙার চেষ্টা ও শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হলে কর্তৃপক্ষই তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেন। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন এবং সেখানে বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিক্ষোভ ও স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতাদের নিয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মর্জিনা আক্তার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললেও তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত অবস্থান ও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে অটল থাকেন।
তবে আন্দোলনকারীদের দাবি অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মর্জিনা আক্তার। তিনি বলেন, পরীক্ষায় খারাপ ফল করা কিছু শিক্ষার্থী আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে। অল্প কিছু শিক্ষার্থী বিভ্রান্তিকর তথ্য পেয়ে এ ধরনের কর্মকা- করছে। তারা পরীক্ষা খারাপ দিয়ে খারাপ ফল করলে বোর্ড কর্তৃপক্ষের তো কিছু করার নেই। তারা আমাদের কিছু লিখিত দাবি জানিয়েছে। বিষয়টি আন্তঃবোর্ডের চেয়ারম্যানকে পাঠাব; আমরা নির্দেশনা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, গত ১৫ অক্টোবর চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। যশোর বোর্ডে পাসের হার ৬৪ দশমিক ২৯। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯ হাজার ৭৪৯ জন শিক্ষার্থী।
একই সঙ্গে ময়মনসিংহে এইচএসসি ও পরীক্ষার ফল প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করেছেন ময়মনসিংহ বোর্ডের শিক্ষার্থী। বেলা ১১টায় টাউন হল মোড়ে শতাধিক শিক্ষার্থী আন্দোলনে যোগ দেয়। কারণ সম্পর্কে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ে গড়মিল ও নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন তারা।