বাংলাদেশে সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ নতুন নয়। তবে দেশটির আইন অনুযায়ী কোনো নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হলেও সেটি বাতিল বলে ঘোষণা করার সুনির্দিষ্ট কোনও নিয়ম নেই।
এর আগে বেশ কয়েকবার সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় সেই পরীক্ষা আয়োজন করা হয়েছে। তবে সেটি করা হয়েছে ‘নীতিগত জায়গা’ থেকে।
এদিকে, সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) আরও কয়েকটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথাও সেখানে দাবি করা হয়েছে।
প্রশ্নফাঁস নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ২৪-এর ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা দেখা গেছে।
অনেকেই বলছেন, যেসব নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, সেগুলোকে বাতিল করা হোক।
পিএসসি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে রেলওয়ে’র সর্বশেষ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি প্রমাণিত হলে সেটি বাতিল করা হবে। তবে পূর্বের পরীক্ষাগুলো নিয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কিন্তু সদ্য হওয়া পরীক্ষা বাতিল করা গেলেও পুরানো পরীক্ষা তথা পুরো নিয়োগ কি বাতিল করা সম্ভব? এসব ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে?
প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের জন্যই বা আইনে কী ধরনের শাস্তির বিধান আছে?
ঘটনা প্রবাহ
গত পাঁচই জুলাই বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘উপ-সহকারী প্রকৌশলী’ পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
তার দু’দিন পরে সাতই জুলাই পিএসসি পরিচালিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রচার করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ২৪।
সেখানে বলা হয়েছে যে পিএসসি’র বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট রেলওয়ে’র ওই পরীক্ষাসহ গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করেছে।
খবর প্রকাশের পরদিন প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পিএসসি’র সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী ও পিএসসি’র তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে বাংলাদেশে কয়েকটি বিসিএস-এর পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছিল।
এর মধ্যে রয়েছে ২৪তম বিসিএস, ২৭তম বিসিএস। এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ৩৩-তম লিখিত পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছিলো।
বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাড়াও আরও অনেক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের খবর বিভিন্ন সময়ে আসতে দেখা যায়। এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও এসব অভিযোগ থেকে বাদ যায়নি।
ঘটনার পর পিএসসি’র প্রতিক্রিয়া
গত আটই জুলাই একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অস্বীকার করে পিএসসি।
সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিলো যে “গত ১২ বছরে বিপিএসসি’তে অনুষ্ঠিত বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষা সম্পর্কে কোনও মহল থেকে কখনোই কোনও ধরনের অভিযোগ বা অনুযোগ ছিল না বলে এটি প্রমাণিত যে, ওইসব পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।”
সেখানে আরও বলা হয়েছে যে প্রশ্নফাঁস রোধ করতে প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষায় ন্যূনতম ছয় সেট প্রশ্নপত্র এবং নন-ক্যাডার পরীক্ষায় ন্যূনতম চার সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। কোন সেটে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, তা নির্ধারণ করতে পরীক্ষা শুরুর ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট পূর্বে লটারি করা হয়।”
এ প্রসঙ্গে গত নয়ই জুলাই আগারগাঁও কর্ম কমিশন ভবনে প্রশ্নফাঁস নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন যে প্রশ্নপফাঁস করা ভীষণ কঠিন।
কারণ “যে প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন নির্ধারণ ও সাপ্লাই করা হয়, সেখানে প্রশ্নফাঁসের কোনো সুযোগ নেই। তবে এ কার্যক্রমের সাথে যেহেতু অনেকেই জড়িত থাকেন, তাই শতভাগ নিশ্চিতভাবেও বলা যায় না।”
তবে পিএসসি তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অস্বীকার করলেও এসকল অভিযোগ তদন্ত করার জন্য গত নয়ই জুলাই তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। ১৫ কার্যদিবসের প্রতিবেদন জমা দেবে তদন্ত কমিটি।
পুরনো পরীক্ষা বাতিল করা সম্ভব?
যে ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এসেছে, সেগুলোর ব্যাপারে পিএসসি’র বক্তব্য জানার জন্য পিএসসি চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করেছিলো বিবিসি বাংলা।
কিন্তু তার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পিএসসি, উভয় সংস্থাই এ বিষয়ে তদন্ত করছে, তাই তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে নতুন কোনও মন্তব্য করবেন না তিনি।
তবে নয়ই জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন যে গত ১২ বছর ধরে যেসব পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর ব্যাপারে “কতটা কী হবে,” তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
তিনি বলেন, “যখনই কোনও পরীক্ষা হয়, তখন সেখানে কোনও অনিয়ম হলে আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে হোক বা পরীক্ষার্থীদের মাধ্যমে হোক, বা বিভিন্নভাবে (অভিযোগ) আসে। ১২ বছর আগের পরীক্ষা নিয়ে এতদিন পরে প্রমাণ কীভাবে হবে?”
পিএসসি’র সাবেক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আইনজীবী, সকলেই বলছেন যে নিয়োগ হওয়ার আগ অবধি পরীক্ষা বাতিল করা গেলেও নিয়োগ বাতিল করা “অসম্ভব” ব্যাপার।
সাবেক শিক্ষাসচিব মো. নজরুল ইসলাম খান বিবিসিকে বলেন, “নিয়োগ পুরোপুরি বাতিল করলে আরেকটা জটিলতা হবে। ইতোপূর্বে যেসব নিয়োগ হয়েছে, সেগুলো বাতিল করার এখতিয়ার পিএসসি’র নাই। তবে দোষীকে আইনের আওতায় আনা যাবে।”
তিনি জানান যে পুরনো সব পরীক্ষা যদি বাতিলও করা হয় তবে তা “হাইকোর্টে টিকবে না।”
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খানও প্রায় একই মন্তব্য করেন।
“যেগুলো অনেক আগে নিয়োগ হয়ে গেছে, সেগুলো বাতিল করার সুযোগ নাই,” বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
পরীক্ষা বাতিল হয় কিসের ভিত্তিতে?
‘পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০’ থেকে দেখা যায় যে প্রশ্ন ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করতে হবে কি না, এ বিষয়ে সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই।
কিন্তু আইনে “সুনির্দিষ্টভাবে” সেরকম কিছু বলা না থাকলেও “এটি জেনারেল কনসিকুয়েন্সেস। যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় ও তা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তো পরীক্ষা বাতিল হওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই,” বিবিসিকে বলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খানও বলেন যে আইনে সুর্নির্দিষ্টভাবে এ বিষয়ে কিছু বলা না হলেও “প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করে দিতে পারবে পিএসসি। সেই ক্ষমতা পিএসসি’র আছে। তবে পিএসসিকে সেটি প্রমাণ করতে হবে।”
এর আগে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের কারণে পরীক্ষা বাতিল করেছিলো পিএসসি।
সে প্রসঙ্গে মি. খান বলেন, “আইনে যা-ই থাক, কিন্তু যদি শোনা যায় যে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, তাহলে প্রশাসনিক দিক থেকেই তো সেই পরীক্ষা বাতিল করা উচিৎ।”
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান মনে করেন যে আইনে না থাকলেও “যেকোনও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে নৈতিকতার মানদণ্ড অনুযায়ী ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে তা বাতিল করতে হবে।”
প্রশ্নবিদ্ধ পরীক্ষায় অভিযুক্তদের কী হবে?
আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বিবিসিকে বলেন যে এক যোগে পুরো নিয়োগ বাতিল করা সম্ভব না।
“আগে চিহ্নিত করতে হবে যে কে ফাঁস করলো ও ফাঁসের পরীক্ষায় কে পাশ করলো। এটা তদন্ত ছাড়া সম্ভব না। তদন্ত হলেও আইনগত অনেক জটিলতা আছে। এটা কঠিন,” বলেন তিনি।
এদিকে এই প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় যার নাম সামনে আসছে, তিনি হলেন সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী।
গণমাধ্যমে খবর আসছে যে যারা প্রশ্ন কিনেছেন, তিনি তার স্বীকারোক্তিতে সেই নামগুলো বলে দিচ্ছেন।
আবেদ আলী’র স্বীকারোক্তি ব্যাপারে খুরশীদ আলম খান বলেন, “সেটি যাচাই করতে হবে যে তিনি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন কি না বা সঠিক বলছেন কি না। তার স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে মন্তব্য করা যাবে না।”
এদিকে মো. শহীদ খান বলেন, “১০-১৫ বছর আগের পরীক্ষা বাতিলের কোনও সুযোগ এখন নাই। রিক্রুট্মেন্ট হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে পরিপূর্ণ তদন্ত করে বের করতে হবে যে বেনিফিশিয়ারি কারা।”
তিনি মনে করেন যে যারা বেনিফিশিয়ারি, অর্থাৎ যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ নিয়েছেন এবং প্রশ্ন কিনে উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়েছেন, তাদেরকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করতে হবে এবং তারা যাতে অন্য কোনও সরকারি চাকরির জন্যও বিবেচিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা উচিৎ।
প্রশ্নফাঁসের সাজা কী?
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের পাবলিক পরীক্ষা আইনে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে প্রশ্নপত্রের প্রকাশনা ও বিতরণ সম্বন্ধে উল্লেখ আছে যে কেউ যদি পরীক্ষার আগে কোনও উপায়ে প্রশ্ন ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণ করেন, তাহলে “তিনি চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।”
তবে এই আইনে সাজা কম হলেও দুদকের আইনে প্রশ্নফাঁসের সাজা সাত বছর, বলেন খুরশিদ আলম।
এক্ষেত্রে নয়ই জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলনে পিএসসি চেয়ারম্যান বলেছেন যে এর আগে যারা প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত ছিল, তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে বরখাস্ত করেছে পিএসসি।
কিন্তু বরখাস্ত হওয়ার পর তারা আবার কোর্টের অর্ডারে ছাড়া পেয়ে গেছে।
এ বিষয়ে সাবেক শিক্ষাসচিব মি. খান বলেন, “এটি বাংলাদেশের কমন চিত্র। কোর্টে গেলে কেউ হুমকি দেয়, সাক্ষী পাওয়া যায় না। তখন কোর্টের অর্ডারে এরা ফিরে আসে। তাই এদেরকে কেউ ঘাঁটায় না।”
আইনের এদিকটা আরও কঠোর হওয়া দরকার বলে মনে করেন আবু আলম মো. শহীদ খান।
“এটি আমাদের রাষ্ট্রের একটি দুর্বলতা। লঘু দণ্ড দিলে শাস্তির মেয়াদ শেষে তার পদায়ন ও পদবি বিবেচনায় চলে আসে। লঘুদণ্ড দিয়ে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।”
সূত্র: বিবিসি বাংলা