২০১৮ সালে বনানীর একটি ফ্ল্যাটে জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়ে খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান। গুম করতে লাশ গাড়িতে করে নেওয়া হয় গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি জঙ্গলে। সেখানে লাশে পেট্রোল ঢেলে আগুনে ঝলসিয়ে দেওয়া হয় চেহারা। সেই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী দেশ পলাতক এক আসামির নাম রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে হৃদয়।
সম্প্রতি দুবাইয়ে আরাভ জুয়েলারি শপ উদ্বোধনী নিয়ে এই হত্যা মামলাটি আবার আলোচনায় উঠে এসেছে। কারণ, কোটি কোটি টাকার এই জুয়েলারি শপের কর্ণধারই হলেন পুলিশ খুনের মামলার পলাতক আসামি আপন। বর্তমানে যিনি আরাভ খান নামে পরিচিত।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নিজের বদলে আবু ইউসুফ নামের এক তরুণকে কারাগারে পাঠানোর আগে ভারতীয় পাসপোর্টে দেশ ত্যাগ করেন আরাভ। এরপর একাধিকবার আবার ফিরে আসেন ১২ মামলার পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘোরা এই আসামি। সর্বশেষ তিন দিন আগেও দেশ থেকে তিনি দুবাই গিয়েছেন। কিন্তু তার যাওয়া-আসায় ভিন্ন এক পাসপোর্ট ব্যবহারের কথা বলছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নতুন করে সেই তদন্তেই নেমেছেন গোয়েন্দারা।
সূত্র বলছে, পুলিশ হত্যা মামলায় আরাভকে আটক করেও ধরে রাখতে পারেননি তদন্তকারীরা। তৎকালীন পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) হস্তক্ষেপে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশের শীর্ষ ওই কর্তার সহায়তায় তিনি দেশও ত্যাগ করেন সে সময়। তার আগে নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করে ভারতীয় এক পাসপোর্টও বানান আরাভ।
বিদেশে গিয়ে নিজের বদলে আবু ইউসুফ নামের এক তরুণকে লোভ দেখিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে পাঠান। পরে অবশ্য জেলে গিয়ে ইউসুফ একপর্যায়ে সত্য প্রকাশ করে দেন। এরপর আদালত বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি)। ডিবির অনুসন্ধানেও নিজের বদলে অন্যকে আসামি বানিয়ে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি প্রমাণিত হয়।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে খুন হন মামুন ইমরান খান। এ ঘটনায় ওই বছরের ১০ জুলাই মামুনের ভাই ঢাকার বনানী থানায় মামলা করেন। এ মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
মামলা ও নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, নারীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া একটি চক্রের কবলে পড়েন মামুন ইমরান খান। এরপর তাকে ধরে নিয়ে হত্যার পর পেট্রোল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুরের জঙ্গলে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা।
এ মামলার ৬ নম্বর আসামি হলেন আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয়।
আরাভের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামে। মামলা ও ঘটনাটি তদন্ত করেন ঢাকা মহানগরের গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল জোনাল টিম।
গোয়েন্দা পুলিশের পদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, এ ঘটনায় আরাভকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়েও আসা হয়েছিল। কিন্তু তাকে ধরে রাখা যায়নি। সে সময় তার কাছে বাংলাদেশি একটি পাসপোর্টও পাওয়া যায়। হৃদি শেখ নামে ওই পাসপোর্টের (নম্বর এনও ০৩৮৫১৮৮) সূত্র ধরে পুলিশের বিশেষ শাখায় চিঠি দিয়ে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি অন্য একটি পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশত্যাগ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ২৮ জুলাই তিনি পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুর উদয় সংঘ ক্লাব এলাকার বাসিন্দা হিসেবে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। জালিয়াতি করে বানানো ওই পাসপোর্টে তার বাবার নাম হিসেবে ব্যবহার করেন জাকির খান, মায়ের নাম দেন রেহানা বিবি খান এবং স্ত্রীর নাম সাজিমা নাসরিন। তার ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বর ইউ ৪৯৮৫৩৮৯। পরে ভারতীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করে আপন আরাভ নাম নিয়ে দুবাই যাতায়াত শুরু করেন। তার পাসপোর্টে শেনজেন ভিসাও রয়েছে।
কার টাকায় ব্যবসা করছেন আরাভ : সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে শোবিজ তারকাদের সঙ্গে ওঠাবসা করা রবিউল ওরফে আপন ওরফে আরাভ উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণদের টার্গেট করতেন। তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে নিজের সিন্ডিকেটের কথিত মডেলদের সঙ্গে মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতেন। সেই দৃশ্য ভিডিও করে বিত্তবান ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করাই ছিল তার মূল কাজ। পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকেও ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা চক্রের অন্যতম একজন ছিলেন এই রবিউল ওরফে আপন। কিন্তু প্রতিবাদ করায় মামুনকে বনানীর একটি ফ্ল্যাটে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
একটি সূত্র জানিয়েছে, রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে আরাভ যে পুলিশ কর্তা পালাতে সহায়তা করেছিলেন, পুলিশের সেই সাবেক কর্মকর্তার অবৈধ অর্থ দিয়েই দুবাইয়ে জুয়েলারির দোকান খুলেছেন তিনি। নেপথ্যে থেকে ব্যবসাটি দেখভাল করাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তাই।
৫ লাখ টাকা ও ক্রিকেটার বানাতে ‘আয়নাবাজি’ করেছিলেন আরাফ : ২০২০ সালের অক্টোবরে আরাফের বদলে আবু ইউসুফ লিমন নামে চাঁদপুরের এক তরুণকে জড়িয়ে কারাগারে পাঠান। দেড় মাস জেল খাটার বিনিময়ে ৫ লাখ টাকা ও বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) খেলার সুযোগ করে দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল তাকে।
সে সময় ভুক্তভোগী পরিবার দাবি করেছিল, আপন তাদের পরিবারে ফোনও করেছিলেন। তাদের পরিবারের খোঁজখবর রাখতেও চেয়েছিলেন।
যেভাবে আবার আলোচনায় পুলিশ কর্তা মামুন হত্যা : গতকাল ১৫ মার্চ আরাভ জুয়েলার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান দুবাইয়ে উদ্বোধন করা হয়। এ স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন নিয়ে দুবাইয়ের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বেশ আলোচনা শুরু হয়।
এর অন্যতম কারণ আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে যারা যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এবং ইউটিউবার হিরো আলম এ উপলক্ষে ভিডিও বার্তা দিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
তারদের মতো ঘোষণা দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দেশের বেশ কয়েকজন অভিনয় ও সংগীতশিল্পী। এমনকি ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের আরও কয়েকজন ক্রিকেটারও। সেখান থেকে উঠে আসে আরাভ খানের নাম।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা-মতিঝিল বিভাগ) মো. রাজীব আল মাসুদ বলেন, আমরা এর আগেও তার লোকেশন শনাক্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। সম্প্রতি সে দুবাইয়ে রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।