করোনার পর প্রথমবারের মতো পূর্ণ নম্বরে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হয়েছে। গত দুই বছর নানা ধরনের ছাড় দেয়ায় পাসের হার বেশি ছিলো। এবার সেই সুযোগ হয়নি। বলছি ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার কথা। এ পরীক্ষা শুরু হয়েছিলো ৩০ এপ্রিল এবং শেষ হওয়ার কথা ছিলো ২৩ মে। আর মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীন দাখিলের লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিলো ২৫ মে। কিন্তু ঘুর্ণিঝড় ‘মোখা’র কারণে একাধিক বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। তাই পরীক্ষার তারিখও পিছিয়ে যায়। ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের অধীন এসএসসি, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন দাখিল পরীক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি ও দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় এ বছর পরীক্ষার্থী ছিলেন ২০ লাখেরও বেশি।
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ মানে দেশব্যাপী স্কুল-মাদরাসায় উৎসবমুখর পরিবেশ। আমাদের জীবনের বাস্তবতা আর রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের আনন্দ ও বেদনার অনুভূতি অনেকটাই ভোতা করে দিয়েছে। কিন্তু এই যে, তরুণ শিক্ষার্থী যারা এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করলেন তারা যেন মজা করতে পারে, আনন্দ করতে পারে সেদিকে প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও সমাজের নিবিড়ভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। তাদের আনন্দে বাধা দানের অধিকার আমাদের নেই। আমরা তাদের এই নির্মল অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আমরা সমাজে যে বিশৃঙ্খল ও অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে রাখি সেটির দায়ভার যেন তাদের ওপর না পড়ে। ফল প্রকাশের দিন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে শাসনের গাম্ভীর্যের বেড়াজাল ভেঙে একাকার হয়ে যান সবাই, উপভোগ করেন যৌথ প্রয়াসে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শিক্ষা কার্যক্রমের মুল্যায়ন। শিক্ষক ভুলে যান পাঁচ বছর পরে এই শিক্ষার্থীরাকে কোথায় থাকবেন। তাদের ক’জনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে, কিন্তু সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষকরা আনন্দে শামিল হন প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। শিক্ষকের বাসায় হয়তো বাজার করার অর্থ নেই, বাসার বহু সমস্যা। সবকিছু ফেলে এই দিনটি ঈদের চেয়েও যেন আনন্দ নিয়ে উদযাপন করেন। শিক্ষকতা জীবনে এইটুকুই তো পাওয়া। সেই শিক্ষকদের আমরা, আমাদের সমাজ কী দিয়েছি? দুই রাজনৈতিক দলের শক্তি পরীক্ষা আর টানটান উত্তেজনার মধ্যে প্রকাশিত হলো বহুল কাঙ্ক্ষিত পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি ও সমমান, শিক্ষার্থীদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।
এবার সারা দেশের ২৯ হাজার ৭৯৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০ লাখ ৭২ হাজার ১৬৩ শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের মধ্যে এসএসসিতে ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ২৭৫ জন, দাখিলে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১২১ জন এবং এস এসসি ও দাখিল ভোকেশনালে ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৯৫ পরীক্ষার্থী ছিলো। এবারও সংশোধিত ও পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাসে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয় এবং তাদেরকে ১০০ নম্বরেই মূল্যায়ন করা হয়েছে। ৩০ এপ্রিল পরীক্ষা শুরু হয়ে মোখার কারণে পিছিয়ে পরীক্ষা শেষ হয় ৩০ মে। সেই হিসেবে ৬০ দিনের আগেই ফল প্রকাশ করা হলো। দ্রুত সময়ে ফল প্রকাশ করা একদিকে পজিটিভ কিন্তু অন্যদিকে মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ৬০ দিনের কম সময়ে ফল প্রকাশ করার মানে হচ্ছে শুধু মূল্যায়নের জন্য একমাসেরও কম সময় পেয়েছেন শিক্ষকরা। এতো কম সময়ে বাসা, বিদ্যালয় ও সামাজিক সব কাজ করে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা এক দুরূহ কাজ। গত বছরের তুলনায় এ বছর পরীক্ষার্থী বেড়েছে ৫০ হাজার ২৯৫ জন। আর মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেড়েছে ২০৭টি, কেন্দ্র বেড়েছে ২০টি। এবার ৪ লাখ ৩১ হাজার ২৩ জন পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। ফরম পূরণ করেও পরীক্ষায় অংশ নেয়নি ৩০ হাজার ৭১৩ জন শিক্ষার্থী। গড় পাস করেছে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। গতবার এই পাসের হার ছিলো ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। এভাবে পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। ২ হাজার ৩৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার শতভাগ। সারা দেশে ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো পরীক্ষার্থীই পাস করতে পারেননি।
পাসের হার সবচেয়ে বেশি বরিশাল বোর্ডে আর সবচেয়ে কম সিলেট শিক্ষা বোর্ডে এবং বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের দাখিল পরীক্ষায়। এ দ্বারা আমরা কি কোনো ম্যাসেজ পাই? এ বছর ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। ২ হাজার ৩৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেননি এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিলো ৫০, অর্থৎ দুটো কমেছে। আর ২ হাজার ৯৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ উত্তীর্ণ হয়েছিলো, সে হিসেবে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ৬২১টি। শতভাগ ফেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই হয়তো সেখানে পরীক্ষা দিয়েছে ২ জন বা ৩ জন এবং এর অধিকাংশই হচ্ছে নন-এমপিও। কারণ, এমপিওভুক্তি হওয়ার জন্য কাম্য শিক্ষার্থী, কাম্য পরিক্ষার্থী থাকতে হয়। এদের জন্য পরীক্ষার্থীর সংখ্যা, শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম, সেই কারণেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই এদের কোনো এমপিওভুক্তি নেই। এদের হয়তো পরীক্ষা দিয়েছে ২ জন, সেই ২ জন পাস করেননি। শতভাগ ফেলের জায়গায় পড়ে গেছে।’
এখানেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিংয়ের প্রশ্নটি চলে আসে। কোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক পাস, জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ও সহপাঠক্রমিক কার্যবালীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা ও অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের র্যাঙ্কিং থাকা প্রয়োজন। এটি করবে কোনো থার্ড পার্টি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কোন বিভাগ নয়। সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, নন-এমপিওভুক্ত নির্বিশেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিং থাকা প্রয়োজন। ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেননি। দেশে একটি র্যাঙ্কিং পদ্ধতি থাকলে আমরা সহজে অনুমান করতে পারতাম এগুলো কোনো শ্রেণিভুক্ত। তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগলোও কিন্তু ভালো করার একটা প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকতো। যারা ‘ডি’ গ্রেডের তারা ‘সি’ গ্রেডে যাওয়ার জন্য, যারা ‘সি’ গ্রেডে তারা ’বি’ গ্রেডে যাওয়ার জন্য একটি প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতো। ‘বি’ ‘সি’ গ্রেড বললে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাই যেন বুঝতে পারেন এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার অবস্থা ও মান, শিক্ষকের যোগ্যতা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংখ্যা, লাইব্রেরি ব্যবহার, প্রাইভেট টিউশনের অবস্থা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কোনো পর্যায়ে আছে।
আনন্দের সংবাদ হচ্ছে দৈনিক শিক্ষাডটকম এবং দৈনিক আমাদের বার্তা ইতিমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিংয়ের কাজটি শুরু করে দিয়েছে। র্যাঙ্কিং কেন প্রয়োজন, এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা অধিদপ্তরগুলোর কী কী সুবিধা ইত্যাদি কারণ উল্লেখসহ ৪ আগস্ট প্রথম র্যাঙ্কিংয়ের ফল ঘোষণা করা হবে। এটি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই একটি আনন্দের সংবাদ।
ইংরেজি ও গণিতের ফল প্রায় প্রতিবছরই সার্বিক ফলে প্রভাব ফেলে। যেসব বোর্ডের শিক্ষার্থীরা এই দুটো বিষয়ে বেশি পাস করেও তারাই অন্য বোর্ডের চেয়ে এগিয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি পাসের হার কমেছে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে। এ বোর্ডের পাসের হার ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। পাসের হারে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সিলেট বোর্ড। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘মানবিকের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে। বিশেষ করে গণিত বিষয়ে তারা দুর্বল। মানবিকের শিক্ষার্থীদের গণিতভীতি দূর করতে আমি পদক্ষেপ নেবো।’ চেয়ারম্যান মহোদয়কে ধন্যবাদ।
কিন্তু আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে বোর্ডগুলোর ভূমিকা কী দেখি? শুধুমাত্র পরীক্ষার ফরম পূরণ করা আর পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সময় চলে যায়। শিক্ষার মানোন্নয়নে বোর্ড কী ধরনের ভূমিকা রাখে বা রেখে চলেছে সে বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। শিক্ষা বোর্ড কি কখনো বিষয় শিক্ষক কিংবা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন বা বিষয়ভিত্তিক মানোন্নয়নের জন্য বছরে দু’একটি কার্যকরী ওয়ার্কশপ কিংবা সেমিনারের আয়োজন করে যেখানে দেশের শিক্ষাবিদদের সঙ্গে শিক্ষকদের মতো বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকে? এর রকম তো খুব একটা দেখা যায় না। বোর্ডে খাতা আনার সময় দেখতাম বিভিন্ন পরীক্ষাকদের একটি প্রশ্নের উত্তর কীভাবে লিখতে হবে, কীভাবে লিখলে কত নম্বর দেয়া হবে এটি নিয়ে মতবিরোধ চলতে থাকতো, এখতো নিশ্চয়ই আছে। ফলে শিক্ষকরা যার যার মতো অনুযায়ী নম্বর দিয়ে থাকেন। ইউনিফর্ম কোনো নিয়ম মেনে অনেক ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরীক্ষার ফল বের হলে চেয়ারম্যানরা অনেক ধরনের ব্যাখ্যা ও আশার কথা শুনিয়ে থাকেন। এটি বাস্তবে কতোটা সম্ভব কিংবা এ ধরনের সংস্কৃতি আমরা তৈরি করতে পেরেছি কি না সেটি বিবেচনার বিষয়।
গত বছরের (২০২২ খ্রিষ্টাব্দে) মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়েছিলো ৫০ নম্বরের, অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত নম্বরে। পরীক্ষার সময় ছিলো দুই ঘণ্টা। এখানে শিক্ষা প্রশাসন ও কৌশলগত কিছু সমস্যা রয়ে গেছে আর পরীক্ষার নম্বর ও সময় বাড়িয়ে দেয়ায় ফলে বড় ধরনের বিভক্তি ও পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। ফলে এ ধরনের পার্থক্য কাছাকাছি এক দু’বছরে শিক্ষার্থীদের উচ্ছশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে ও চাকরিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। এবার পরীক্ষার পূর্ণমান ছিলো ১০০ নম্বরই। পরীক্ষাও হয়েছে তিন ঘণ্টা, ফলে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী গতবারের মতো পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি। পাসের হার কমেছে ৭ দশমিক ০৫ আর জিপিএ-৫ কমেছে ৮৬ হাজার ২৪ জন। পরীক্ষা যতো নম্বরেরই হোক, নম্বর যতোই থাকুক স্ট্যান্ডার্ড থাকবে একই। খাতা মূল্যায়ন ও প্রশ্নপত্র তৈরি সেভাবেই হতে হবে। তা না হলে এটি মূল্যায়ন ব্যবস্থার দুর্বলতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বিষয়টি আমরা আলোচনা না করে শুধু কারণ দেখিয়ে দিই, তাতে পাশাপাশি বছরের শিক্ষার্থীদের ফলে যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় সেটি তাদের উচ্চশিক্ষার জীবন, চাকরি জীবনে এবং কেউ বিদেশে পড়াশোনা করলে সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়ে। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা প্রয়োজন।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও লিড-এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ টিম, দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তা