খুব দরকার ছিলো, তাই চাইলেই যে কেউ একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুরু করতে পারতেন। সংকট ছিলো বলে মোটামুটি মানের শিক্ষা সনদ নিয়েই শিক্ষক পদে নিয়োগও পেতে পারতেন। যদিও এসব যুগ যুগ আগেকার কথা। এখন সময় বদলেছে। সময়ে সময়ে নতুন নিয়ম-কানুনও হয়েছে। তাই বলে অতীতকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। জানা অজানা বিদোৎসাহী মানুষেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না গড়লে, নামকাওয়াস্তে বেতন জেনেও শিক্ষক পদে এগিয়ে না এলে আজকের এই নিয়ম-কানুন কোথায় কাদের জন্য প্রযোজ্য হতো? ভিত্তিটা তৈরি করে দিয়ে গেছেন বলেই তারা চিরনমস্য। চিরসস্মরণীয়ও।
সেই চিরনমস্যরা শিক্ষানুরাগীদের মন ও মানসে চির জাগরুক রয়েছেন বলেই মাঝেমধ্যে নিজেকেই নিজের কাঠগড়ায় তুলে শিক্ষা বিষয়ক কোনো প্রক্রিয়ার প্রাসঙ্গিকতা যাচাইয়ের দায় থাকে। এমনই একটি দায়বদ্ধতাপূর্ণ প্রসঙ্গ হলো শিক্ষক নিয়োগ ও এর প্রক্রিয়া। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে, ডিজিটাল যুগে বিদ্যা ও জ্ঞানার্জনের অবারিত সুযোগের কালে দুই-পাঁচ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষায় একজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের চূড়াস্ত সুপারিশ কতোটা যৌক্তিক?
দুই থেকে পাঁচ মিনিটের ভাইভা পদ্ধতিকে নিশ্চয়ই অবজ্ঞা করছি না, ভুলও বলছি না, নেতিবাচক সমালোচনাও করছি না। কারণ, হাইস্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের আগে এতোটুকুও অনুপস্থিত ছিলো। তারও আগে অর্থাৎ ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের আগে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়েরও কোনো নিয়ম ছিলো না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধুই নিয়মরক্ষার অথবা সাজানো নিয়োগ পরীক্ষা ছিলো। সেটাও বেসরকারি ব্যবস্থাপনা কমিটির হাতে। আর তাতেই মিলতো সরকারি কোষাগার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন-ভাতার টিকিট- নাম যার এমপিও, যার অর্থ মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (বেতন-ভাতার সরকারি অংশ)।
এবার আসি পৌনে পাঁচ মিনিটের যাচাইয়ে বেসরকারি হাইস্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এন্ট্রি লেভেলে শিক্ষক পদে চূড়ান্তকরণ প্রসঙ্গে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরের গেজেট অনুযায়ী এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক পদে নিয়োগের প্রার্থী যাচাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষকে (এনটিআরসিএ)। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে যাত্রা শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটি মাধ্যমিক থেকে ডিগ্রি পাস কোর্সের শিক্ষক পদে নিয়োগে প্রার্থীদের প্রাক-যোগ্যতা যাচাই করে প্রত্যয়ন বা সনদ দেয়ার (বার কাউন্সিল সনদের মতো) কাজটি করতো। শুধু সেই সনদধারীদের আবেদন করার সুযোগ দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে নিয়োগ পরীক্ষা নিতো। দিনে দিনে দায়িত্ব বাড়তে থাকলেও সৃষ্টির শুরু থেকে একই অরগানোগ্রামেই চলছে প্রশাসন ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত এনটিআরসিএ।
এবার আসি শিক্ষক নিবন্ধন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে। আগ্রহী প্রার্থীদের কাছ থেকে নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে অনলাইনে আবেদন নেয় এনটিআরসিএ। পরে আয়োজন করা হয় একশ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। এমসিকিউ পদ্ধতিতে নেয়া এ পরীক্ষায় প্রার্থীরা বৃত্ত ভরাট করে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে অনেকটা তাদের মুখস্থবিদ্যার পারদর্শিতার প্রমাণ দেন। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়ে এরপর বিষয়ভিত্তিক ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা আয়োজন করা হয়। বিষয়ভিত্তিক গতানুগতিক প্রশ্ন হওয়ায় প্রার্থীরা নিজ নিজ বিষয়ের নির্দিষ্ট পাঠ মুখস্থ করারই প্রমাণ দেন। এজন্য দুই পরীক্ষার জন্যই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু কোচিং, ছাপানো হয় লাখ লাখ কপি বাণিজ্যিক গাইড বই। মুখস্থ বিদ্যা যাচাইয়ের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় কোন কোচিংয়ের সাজেশন থেকে বেশি কমন আসে, বা কোন গাইড থেকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন কমন আসে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে ‘কমেন্ট যুদ্ধ’। তবে শিক্ষক হতে মুখস্ত শক্তির পরেও যেসব শক্ত নৈতিক ও মানসিক সততা এবং মানবিকগুণাবলী প্রয়োজন সেগুলো কি যাচাই হয়? বর্তমান পদ্ধতিতে যাচাইয়ের সুযোগ আদৌ কি রয়েছে?
অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, এসব বিষয়ে যৎসামান্য চেষ্টা করা হয় ভাইভা বা মৌখিক পরীক্ষায়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মেলে ভাইভায় অংশ নেয়ার সুযোগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষক নিবন্ধনের ভাইভা নিতে বরাবরের মতো এবারও মোট ৮টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। পাঁচ-সদস্যের প্রতিটি বোর্ড দুই ঘণ্টা সময় পাচ্ছেন মোট ২৫ জন প্রার্থীর ভাইভা নিতে। সে হিসেবে ভাইভায় বসতে একজন প্রার্থী গড়ে সর্বোচ্চ ৪ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড সময় পাচ্ছেন।
এসময়ের মধ্যে প্রার্থীদের মুখোমুখি হতে হয় বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নের। দেখা হয় তাদের শিক্ষা সনদ। তাহলে মানবিকগুণাবলীর যাচাইয়ে কতো সেকেন্ড সময় পাওয়া যায়? এভাবে নিয়োগ হওয়া শিক্ষকরা সরাসরি শ্রেণিকক্ষে গিয়ে কতো ভালো করবেন তা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠতেই পারে। যেহেতু এসব পদে নিয়োগের জন্য শুরুতেই বিএড/এমড সনদ থাকা বাধ্যতামূলক নয়। আর শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সিরিয়াল পেতে লেগে যায় ছয় সাত বছর।
গত কয়েকবছরে ভাইভায় অংশ নেওয়া প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাইভায় তাদের একাডেমিক প্রশ্ন ও কিছু গতানুগতিক বিষয় জানতে চাওয়া হয়। মানবিক গুণাবলী যাচাইয়ের প্রশ্ন এক-দুইটি করা হলেও তা কি শ্রেণিকক্ষে শিশু সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিতে যথেষ্ট?
এবার আসি যারা মৌখিক পরীক্ষা নেন তাদের প্রসঙ্গে। প্রথমবার যখন ভাইভা শুরু হলো তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে একটা তালিকা চাওয়া হলো। সেই তালিকায় প্রাধান্য পেলেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সেসব কর্মকর্তারাই যারা যুগ যুগ ধরে শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে অধিদপ্তর/দপ্তর ও বোর্ডে চাকরি করছেন। তাই ভাইভায়ও শিক্ষক হওয়ায় উপযুক্ত প্রশ্ন বা পরীক্ষার চেয়ে গতানুগতিক প্রশ্ন হওয়ায় অবাক হইনি।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে, পাঁচ সদস্যের ভাইভা বোর্ডের প্রধান থাকেন প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা, যিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব বা তদুর্ধ্ব পর্যায়ের পদে নিয়োজিত। আরো থাকেন প্রার্থী যে বিষয়ের সে একজন বিশেষজ্ঞ, যিনি মূলত সরকারি কলেজ শিক্ষক। শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত এ শিক্ষকই ভাইভা বোর্ডে থাকা সবেধন নীলমনি, যার শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেয়ার অভিজ্ঞতার সুযোগ রয়েছে। ভাইভা বোর্ডে আরো থাকেন এনটিআরসিএর একজন কর্মকর্তা। আর সনদ যাচাই ও তথ্য অন্তর্ভুক্তিসহ অন্যান্য কাজে ওই তিনজন কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করতে এনটিআরসিএর একজন তৃতীয় শ্রেণির ও একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তার মানে শ্রেণিকক্ষে, পাঠদান করানোর জন্য অথবা শিক্ষাক্রম বা সিলেবাস বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা সংখ্যালঘু।
ভাইভার মুখোমুখি হওয়া প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৪ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে তাদের কাছ থেকে সেই মুখস্থ করার পরদর্শিতা যাচাইয়ের প্রশ্নই বেশি করা হয়। কেউ কেউ এক দুই মিনিটেই ভাইভা শেষ করে বেরিয়ে আসেন। প্রশাসন ক্যাডার প্রভাবিত ভাইভাবোর্ডে অনেক সময় লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নও জানতে চাওয়া হয়। কদাচিৎ জানতে চাওয়া হয়, শ্রেণিকক্ষ সম্পর্কিত প্রশ্ন। প্রার্থীদের প্রশ্ন করার মূল দায়িত্বে থাকা শিক্ষা ক্যাডারের বিষয় বিশেষজ্ঞরা একাডেমিক প্রশ্নেই বেশি জোর দেন। কারণ ভাইভা বোর্ডে তাদের ডেজিগনেশন ‘বিষয় বিশেষজ্ঞ’।
ভাইভার গণ্ডি উতরে যাওয়া প্রার্থীরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন। তার তদারকিতে থাকে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম। শিক্ষক হওয়ার জন্য একাডেমিক যোগ্যতা এখানে মূল হলেও কোমলমতি শিশুর জীবনে সেই ব্যক্তির মানসিক প্রভাব অনেক। তার তদারকিতেই দিনের একটি বড় সময় থাকেন শিশুরা।
যদিও আগের চেয়ে কমে এসেছে, তথাপি এখনো ক্লাসে শিশু নির্যাতনের খবর আসে অহরহ। শিক্ষকদের একটা বড় অংশ এখনো মনে করেন বেত ছাড়া চলে না। এনটিআরসিএ এর ভাইভা উৎরাতে আসা নতুন শিক্ষকরাও তা মনে করেন কি-না তা জানার সুযোগ হয়তো হয় না পৌনে পাঁচ মিনিটের ভাইভায়।
শিক্ষার এমন মহাসংকট কাটাতে আমরা কতোটা পেরেছি? চেষ্টাই বা করেছি কতোটা? শিক্ষক হওয়ার টিকিট দেয়ার ভাইভায় একজন মনোবিজ্ঞানী কি রাখা যায় না? ৪ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড সময়টা একটু বাড়িয়ে প্রার্থীর কোনো ভয়ংকর মানসিক সমস্যা আছে কি-না, তিনি প্যাথোলজিক্যাল লায়ার, স্যাডিস্ট, সিরিয়াল কিলার বা নেহেলিস্ট কি-না- এসব যাচাই করা কী অসম্ভব? এক বা একাধিক বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করা যায় না?
সম্ভাব্য শিক্ষক ফেসবুকে কি লিখছেন, কি শেয়ার করছেন সেসব যাচাই করলেও তো তার মন ও মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা মেলে। ডেমো ক্লাস নিলে তার সামর্থ ও সক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। এভাবে মুখস্থ বিদ্যা যাচাই করে কাউকে জাতি গড়ার কারিগর হয়ে সরকারি বেতন (এমপিও) পাওয়ার সুযোগ করে দেয়া কী ঠিক হচ্ছে?
প্রায় হলফ করে বলতে পারি, এখন যারা বেসরকারি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে সরকারি কোষাগার থেকে এমপিও পান বা পাবেন তারা মাত্র কয়েকবছরেই পর্যায়ক্রমে সরকারি শিক্ষক হয়ে যাবেন। তার মানে, তাদের সুবিধা আরো বাড়বে। কিন্তু, সক্ষমতা বাড়বে কি? প্রচলিত পরীক্ষা নিয়ে আমরা কি আসলেই যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছি? শিক্ষক দিবসে তোলা এসব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন দায়িত্বপ্রাপ্তরা যেনো বিশেষভাবে ভেবে দেখেন।